অনড় অবস্থানে দু দল : রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার: দু প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অনড় অবস্থানের কারণে বিরাজমান রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি কূটনীতিক এবং দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। একই আশঙ্কা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, পেশাজীবী সংগঠন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরও।
তাদের মতে, দু দল এবং জোট- যে যার জায়গায় অনড়। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। যে কারণে বাড়ছে উদ্বেগ। বাড়ছে সহিংসতা। স্থবির হয়ে যাচ্ছে অর্থনীতির চাকাসহ সামগ্রিক জনজীবন। পরিস্থিতি যখন ক্রমাগত অবনতির দিকে, ঠিক তখন এ নিয়ে বারবার নিজেদের গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা বলে যাচ্ছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিদেশি কূটনীতিকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা। দশম জাতীয় সংসদের বর্ষপূর্তির দিন থেকে বিএনপি টানা অবরোধের সঙ্গে হরতাল পালন করে যাচ্ছে। গত ৫৩ দিনে ১৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সহিংসতা বন্ধ না করলে সরকার সংলাপে বসবে না। বিএনপিও আন্দোলন থামিয়ে সংলাপে যাবে না। ফলে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দেশে-বিদেশে উদ্বেগ বাড়ছে। বিকার নেই শুধু প্রধান দুই দলের।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছে। কিন্তু সরকার বা বিএনপি কেউ তাদের উদ্বেগ আমলেই নিচ্ছে না। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে, তারা এক চুল পরিমাণও ছাড় দেবে না। সংলাপেও বসবে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি আইনি উপায়েও বিএনপিকে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
অন্যদিকে বিএনপিও অনড়। টানা অবরোধের সঙ্গে হরতাল দিয়ে মাঠে আছে। ১ মার্চ থেকে আরও কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে তারা। ইজতেমা, এসএসসি পরীক্ষা, পয়লা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি- এসব জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতেও বিএনপি তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেনি। হরতালমুক্ত অবস্থায় এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা একটি পরীক্ষাও দিতে পারেনি। একুশে ফেব্রুয়ারির মতো একটি বিশেষ দিনেও তারা অবরোধ প্রত্যাহার করেনি। আদালতে হাজির না হওয়ায় জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিকেও আমলে নিচ্ছে না বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটির সদস্যরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ব্রাসেলসে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাকালে উপকমিটির সদস্যরা তাদের উদ্বেগের কথা জানান। চলমান রাজনৈতিক সংকটের ব্যাপারে প্রধান দুই দলের অনড় অবস্থানের কারণে সমস্যা সমাধানের কোনো লক্ষণ নেই বলে মনে করছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটির সদস্যরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিরোধী দল কোণঠাসা হয়ে পড়বে। একে কাজে লাগিয়ে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটতে পারে, অন্য শক্তিগুলো সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে বলেও তারা আশংকা প্রকাশ করেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তবে তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এটা পরিস্থিতি আরও উসকে দেবে বলে তারা মনে করেন।
বৃহস্পতিবার দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ওয়াশিংটনে প্রেস বিফ্রিং বলেন, রাজনীতিতে সংঘাতের কোনো স্থান নেই। একইসঙ্গে এটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে, সরকার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের সুযোগ করে দেবে। এজন্য প্রয়োজন একটি অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আর গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানো হচ্ছে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বুধবার বিরোধী নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নেশা দেশাই বলেন, প্রথমত আমি আরোপিত (খালেদা জিয়ার ওপর) অভিযোগগুলো নিয়ে কোনো জল্পনা-কল্পনা করতে চাই না। আমরা প্রত্যাশা করি, কোনো প্রকার অভিযোগ দাখিলের ক্ষেত্রে আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সক্ষম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক সহিংসতার মাত্রা নিয়ে আমাদের ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের সহিংসতা পরিহার করা প্রয়োজন। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল, সরকারের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সক্রিয় থাকার সুযোগ নিশ্চিত করা।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা সম্পর্কে জাতিসংঘ সজাগ রয়েছে বলে জানানো হয়। জাতিসংঘ সদর দফতরে নিয়মিত ব্রিফিংকালে মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র স্টিফানে ডুজারিক এ কথা জানিয়েছেন। মুখপাত্র একথাও বলেছেন যে, জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন আছেন।
জামায়াতে ইসলামীও সরকারবিরোধী আন্দোলনে আরও সক্রিয় এবং জোরদারভাবে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে টিএসসিতে নিহত হন ব্লগার অভিজিৎ রায়। এই ঘটনাও পরিস্থিতির আরও অবনতির ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দাবি করেছেন। তাদের মতে, সব মিলিয়ে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে দেশ।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটির সদস্যরা দাবি করেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। দুর্ভাগ্যবশত, পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে তা নেতিবাচক। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সন্তোষজনক নয়। ইওসেফ তার বক্তব্যে বলেন, ৫ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশজুড়ে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৬০ জনের বেশি মারা গেছেন। বিরোধী দলের ৭ থেকে ১০ হাজার কর্মী গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ। তারা নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সরকারের দাবি তারা বৈধভাবে নির্বাচিত। কাজেই এ সংঘাত, এ দ্বন্দ্ব^ সমাধান করাটা কঠিন। উভয় পক্ষ তাদের অবস্থানে অনড়। যেসব যুক্তিতর্ক তাদের পক্ষ থেকে প্রদর্শন করা হয়েছে তা হল- বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা হিসেবে অতীত ঘটনাপ্রবাহ উপস্থাপন করা। তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে আমরা সমঝোতার কোনো সুযোগ দেখিনি। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে অটল। রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও আমরা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা সম্পর্কে জাতিসংঘ সজাগ রয়েছে বলে জানানো হয়। জাতিসংঘ সদর দফতরে নিয়মিত ব্রিফিংকালে মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র স্টিফানে ডুজারিক এ কথা জানিয়েছেন। মুখপাত্র এ কথাও বলেছেন যে, জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন আছেন।
এছাড়াও নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে চলমান সঙ্কটের সমাধান হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দলের সদস্য ও প্রভাবশালী পার্লামেন্টারিয়ান জোসেফ উইডেনহোলজার। জার্মানির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। গত বুধবার সংবাদ মাধ্যমটির অনলাইনে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এর ফলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
বুধবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান প্রেদা বলেছেন, সেনা হস্তক্ষেপ ও গৃহযুদ্ধের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, একদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ২০১৪ সালের নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দাবি করে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যস্ত রয়েছে।