অধিকার ধুলুণ্ঠিত

কামরুজ্জামান বেল্টু: ট্রলি সিঁড়িটির নাম এখন তেলা সিঁড়ি। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের এ সিঁড়িটি দিন ও রাতের অধিকাংশ সময়ই থাকে নির্জন। একা গেলে গা ছমছম করার মতো ভূতুড়ে। এই ভূতুড়ে পরিবেশকে আরো ভীতিকর করে তুলেছে ‘বাঁচাও, বাঁচাও, পেট গেলো’ বলে নারীকণ্ঠের করুণ আকুতি। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে মধ্যবয়সী নারীর পেতে বসা সংসার।

গবেষকরা যখন বলছেন, পিঁপড়েও মল-মূত্র ত্যাগ করে শোয়া বসার ডেরার দূরে, তখন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসাতালের ট্রলি সিঁড়ির মাঝে সংসার পেতে বসা মধ্যবয়সী নারীর সে জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। ফলে শোয়ার জন্য পেতে রাখা কাঁথাকাপড়ের পাশেই ত্যাগ করছেন মল-মূত্র। দুর্গন্ধ দিন দিন বিকট হচ্ছে। দেখবে কে?

মধ্যবয়সী বললে কিছুটা ভুল হবে। ওই বয়সও বোধ হয় কয়েক বছর আগে পেরিয়ে এসেছেন তিনি। গায়ের চামড়া হাড়ের সাথে লাগোয়া। চোখে মুখে অনিশ্চয়তার ছাপ। কাছে কাউকে পেলেই চাচ্ছেন ওষুধ। জ্বলে গেলো, পুড়ে গেলো। পেটের ওষুধ দাও। কেউ ওষুধ দিলে মুহূর্তেই গিলে নিচ্ছেন তিনি। কোথা থেকে এলেন, ঠিকানাই বা কি?

খানিক নীরব থেকে স্মৃতি হাতড়ে তিনি বললেন, তখন ছোট ছিলাম। মা মারা গেলো। মাকে হারিয়ে বাপও পড়ো হয়ে গেলো। চাচারা এক বাড়িতে রেখে দিলো। বড় হলাম। বিয়ে হলো। মেয়ে হলো। মেয়ের বিয়ে হলো গড়চাপড়ায়। যার বাড়িতে থেকে বড় হলাম, সেও মারা গেলো। আমাকে দেখবে কে? পেটের যন্ত্রণায় কোনো বাড়িতে কাজও আর করতে পারিনে। তাই তো স্টেশনে ভিক্ষে করতে লাগলাম। সেখানেও থাকা হলো না। হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি।

নাম মালেকা বানু। পিতার নাম সন্টু। হাজরাহাটি বাড়ি ছিলো বলে জানালেও তিনি যে সঠিকই বলছেন তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। সপ্তাখানেক ধরে বৃদ্ধা হাসপাতালের ট্রলি সিঁড়িতেই রয়েছেন। অধিকাংশ সময়ই কাটছে যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণের আকুতি জানিয়ে। কৌতুহলবশে কেউ গেলে মালেকা বানুর অকুতি এড়াতে না পেরে কেউ কেউ দিচ্ছেন এক-দু পিস পাউরুটি। কেউ দিচ্ছেন এক দু পাতা ব্যথার বড়ি।

মন্তব্য করতে গিয়ে কেউ কেউ বলছেন, শেষ ঠিকানায় যাওয়ার আগে কয়েক দিনের জন্য অনেকেরই ঠিকানা হয় হাসপাতালের বারান্দা। কে জানে মালেকা বানুকে জান্নাতুল মওলায় যেতে কতোদিন পড়ে থাকতে হবে ওভাবে? নাকি হাসিনা বানুর মতো মারা যাওয়ার পর তার টাকার ব্যাগ ছিঁড়ে টাকা গোনার জন্যই ব্যস্ত হবেন অনেকে? হাসিনা বানুর কাছে রাখা বস্তায় টাকা থাকলেও তা নষ্ট হয়েছে। অথচ তিনি মরেছেন অনেকটাই বিনা চিকিৎসায়। হাসিনা বানু বা মালেকা বানুদের চিকিৎসার জন্য যদি হাসপাতাল সমাজসেবা ঘুরেও না তাকায় তাহলে ওটা কাদের জন্য? মালেকা বানু আর কতোটা জোরে চিৎকার করলে তার চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার বাস্তবায়ন হবে? এসব প্রশ্নের জবাব নিশ্চয় স্বাস্থ্য বিভাগের কিতাবে সংরক্ষিত।