স্মরণকালের সব রেকর্ড ভেঙে দর্শক ভিড়ের নতুন রেকর্ড ॥ বাধভাঙা উল্লাসে মুখরিত খেলার মাঠ

জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবলের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে টাঙ্গাইলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে চুয়াডাঙ্গা

ইসলাম রকিব/আলম আশরাফ: স্মরণকালের সব রেকর্ড ভেঙে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট নতুন রেকর্ড গড়েছে। গতকাল কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম দিনে জেলা স্টেডিয়ামে দর্শকের ভিড়ে তিলধরানোর ঠাঁই-ই শুধু ছিলো না, স্টেডিয়ামের বাইরের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে ছিলো পিঁপড়ের সারির মতো মানুষের সারি। স্টেডিয়ামে মুর্হুমুর্হু করতালি পুরো এলাকার পরিবেশকেই করে তোলে উৎসবমুখর। যেন বাধভাঙা আনন্দের বন্যা। ভিড় সামলে কিছুটা বিলম্বে মাঠে প্রবেশ করেন মূল উদ্যোক্তা চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ। তিনি ও পুলিশ সুপারসহ কর্মকর্তাদের অনেকেই শরিক হন উল্লাসে। অপরদিকে মাঠের বাইরে রাস্তার পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশকে শুধু হিমিশিমই খেতে হয়নি, স্টেডিয়ামে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি দর্শকের উপস্থিতি দুর্ঘটনার শঙ্কায় শঙ্কিতও করে তোলে অনেকের। ভাগ্যিস ঘটেনি দুর্ঘটনা। টান টান উত্তেজনাপূর্ণ উৎসবমুখর খেলায় গতকাল টাঙ্গাইলকে ২-১ গোলে হারিয়ে চুয়াডাঙ্গা সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জাফরপুর-নূরনগরে নতুন নির্মিত জেলা স্টেডিয়ামটির মোট ধারণ ক্ষমতা কতো? কেউ বলেছেন ১২ হাজার, কেউ বলেছেন ২২ হাজার। যে যাই বলুক দর্শক যে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি ছিলো তা নিয়ে বির্তক নেই। তবে গতকাল সোমবার দুপুরের পর থেকেই চুয়াডাঙ্গার প্রতিটি সড়কেই যেন উৎসবের আমেজ ফুটে ওঠে। প্রায় সকলেরই অভিমুখ স্টেডিয়ামে জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল চুয়াডাঙ্গা একাদশ বনাম টাঙ্গাইল একাদশের খেলা। উদ্বোধনের দিনেও ভিড় ছিলো উপচেপড়া। তবে গতকালের মতো অতোটা বাধভাঙা ছিলো না। দর্শকের ভিড় দেখে ফাইনালের ভিড় সামলানো নিয়ে আয়োজকদের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। রুচিশীল আয়োজনে যে দর্শকের অভাব নেই গতকালই তার উৎকৃষ্ট উদাহারণ। লা-লিগা, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ,ওয়েফা, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ কিম্বা চ্যাম্পিয়ণ লিগ যাই বলা হোক না কেন, স্মরণকালের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবলের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে দর্শকের উপস্থিতি। চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া জেলা থেকেও দর্শক পিপিলিকার সারির মতো আসতে থাকে চুয়াডাঙ্গা জেলা স্টেডিয়ামে। লক্ষ্য একটিই, স্বাগতিক চুয়াডাঙ্গা ও শক্তিশালী টাঙ্গাইলের মধ্যেকার জমজমাট ফুটবল লড়াই দেখা। রেফারির লম্বা বাঁশির শব্দে যখন প্রথমার্ধের খেলা শুরু হয়, তখন বিকেল ৪টা। স্টেডিয়ামের গ্যালারির কোথাও তিল ধরানোর ঠাঁই নেই। খেলার ১৯ মিনিটে যখন চুয়াডাঙ্গা জেলা দলের রাব্বী টাঙ্গাইলের জালে বল জড়িয়ে দেন, তখন দর্শকদের চিৎকার আর আনন্দ উল্লাসের শব্দে সারা চুয়াডাঙ্গা যেন প্রকম্পিত হতে থাকে। এ কম্পনের শব্দে আউটার স্টেডিয়ামে মাঠে ঢোকার অপেক্ষায় থাকা আরো হাজার দশেক দর্শকদের হুঙ্কারে স্টেডিয়াম এলাকা যখন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে ঠিক তখনই খেলার ৩০ মিনিটে আবারো চুয়াডাঙ্গা দলের বিদেশি খেলোয়াড় ঈসমাইল মাংগুরার দেয়া দ্বিতীয় গোল জড়িয়ে যায় টাঙ্গাইলের জালে। আর কি দর্শক ঠেকানো যায়। প্রথমার্ধের খেলার শেষ বাাঁশি বাজানোর সাথে সাথে বাধভাঙ্গা জোয়ারের মতো গ্যালারিতে ঠাঁই না পাওয়া দর্শক লোহার তারকাঁটা পেরিয়ে ঢুকে যান মাঠে। দৃশ্য দেখে অনেকেই মন্তব্য করেন এতো আনন্দ মুহুর্তে ম্লান হয়ে যাবে না তো? দর্শকের চাপ সামলাতে পুলিশ বাহিনী যখন খাচ্ছে নাকানি-চুবানি তখন ডাকা হয় বিজিবিকে। দর্শক তাতেও যখন মানলো না বাধা, তখন ভিআইপি গ্যালারি থেকে টুর্নামেন্টের রূপকার জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ উঠে গিয়ে মাঠ ইজারাদারদের বলেন আর টিকিট বিক্রি করা নয়। উন্মুক্ত করে দেয়া হোক টিকিটের সকল বেড়াজাল। সাথে সাথে মূল মাঠে ঢোকার প্রধান গেট খুলে দেয়া হয় ডিসির নির্দেশে। মুহূর্তে উত্তাল সাগরের জলোচ্ছ্বাসের মতো দর্শক মূলমাঠে প্রবেশ করে সবুজ ঘাস পরিপূর্ণ করে দিল কালো চুলের মাথায়। ফাঁকা থাকলো শুধু ১২০ গজ বাই ৮০ গজের তৈরি ফুটবল খেলার জায়গাটুকু। তখনও গ্যালারির বাইরে অবস্থান করছে হাজারো দর্শক। তারা না ঢুকতে পেরে ভগ্নমনোরথে ফিরে যান বাড়ির উদ্দেশে। রেফারির লম্বা বাঁশিতে আবার যখন শুরু হলো দ্বিতীয়ার্ধের খেলা, তখন দুরে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে খেলা উপভোগ করাই যেন দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। খেলার ৫৮ মিনিটে টাঙ্গাইল দলের ইলিয়াস যখন চুয়াডাঙ্গার বিপক্ষে গোল করে বসেন, তখনও দর্শকরা উৎসাহমূলত করতালিতে মুখোরিত করে তোলে পরিবেশ। কারণ দর্শকরা যে মাঠে এসেছে ভালো খেলা দেখার জন্য। ব্যবধান দাড়ায় ২-১ এ। শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষে আর কোনো গোল না হওয়ায় স্বাগতিক চুয়াডাঙ্গা জেলা দল দর্শক সমর্থকদের আনন্দ বন্যায় ভাসিয়ে ২-১ গোলে জয়লাভ করে টাঙ্গাইলের বিরুদ্ধে। টুর্নামেন্টের প্রথম দল হিসেবে সেমিতে নাম লেখালো সরোয়ার হোসেন মধুর শিষ্যরা। খেলার শেষ বাঁশি বাজার পরপরই প্রতিদিনের মতো টিম পুরস্কার ও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার দিতে যখন সবাই প্রস্তুত তখন সেরা খেলোয়াড় বাছাই নিয়ে কিছুটা ধু¤্রজালের সৃষ্টি হয়। দর্শক কিন্তু তখনো মাঠ ছাড়েনি। দর্শকদের ব্যাপক উপস্থিতি ও ফুটবলের প্রতি তাদের ভক্তি দেখে জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ বলেন, আজকের ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় মাঠের সকল দর্শক। তবে শেষ পর্যন্ত সেরা খেলোয়াড় বাছাই কমিটির অন্যতম সদস্য সাবেক কৃতী ফুটবলার মাহমদুল হক লিটন আলোচনান্তে টাঙ্গাইল জেলা দলের পক্ষে একমাত্র গোলদাতা ইলিয়াসকেই দিয়ে দেন সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব। তাকে ম্যান অব দা ম্যাচ ঘোষণার পর কিছুটা উত্তেজনাও দানা বাধে।
গতকাল খেলার মাঠে ভিআইপি গ্যালারিতে দর্শক হিসেবে খেলা উপভোগ করেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহম্মেদ, পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান পিপিএম, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাতীয় ক্রীড়া সংগঠক রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুল হক বিশ্বাস, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সি আলমগীর হান্নান, ডিএফএর সভাপতি রফিকুল ইসলাম লাড্ডু, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতি মজিবুল হক মালিক মজু, এ নাসির জোয়ার্দ্দার, হুমায়ুন কবীর মালিকসহ জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এছাড়া সুদূর কানাডা থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদকে ও সেমিফাইনালে উন্নীত হওয়া চুয়াডাঙ্গা জেলা ফুটবল দলের সকল খেলোয়াড় কর্মকর্তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সাবেক জাতীয় দলের কৃতী ফুটবলার মামুন জোয়ার্দ্দার।
চুয়াডাঙ্গা জেলা দল ভালো খেলে সেমিফাইনালে উন্নীত হওয়ায় চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন, চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার ও চুয়াডাঙ্গা জেলা দলের ম্যানেজার মাহাবুল ইসলাম সেলিম সকল খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। একই সাথে আরো ভালো খেলে ফাইনালে উন্নীত হওয়ার জন্য জেলাবাসীর নিকট দোয়া কামনা করেছেন। আজ মঙ্গলবাল একই মাঠে বিকেল ৩টায় দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে নাটোর জেলা দল মুখোমুখি হবে জয়পুরহাট জেলা দলের বিপক্ষে।
গ্যালারিতে হাজার হাজার দর্শক চুয়াডাঙ্গা বলে চিৎকার। কানায় কানায় ভরা ছিলো গ্যালারি। দর্শকদের এমন রূপ যেন ফিরিয়ে এনেছে। দেশের ফুটবলের সেই সোনালি সময়কে। খেলা শুরু হওয়ার দু ঘণ্টা আগে থেকেই মূলফটকের সামনে হাজার হাজার দর্শকের জটলা। আড়াইটা বাজতে না বাজতে মাঠে ভেতরে গ্যালারিতে কানায় কানায় পূর্ণ হলো দর্শক। খেলা আধাঘন্টা পেরিয়ে গেলেও বাইরে হাজারো দর্শকের জটলা থেকে যায়। গ্যালারিতে উপচেপড়ায় ততোক্ষণে নিরাপত্তাকর্মীরা সব ফটক বন্ধ করে দিয়েছেন। ভেতরের জনসমুদ্রের গর্জনে মিলিয়ে যাচ্ছিলো বাইরের অপেক্ষমানদের হাহাকার। গ্যালারিতে উপচেপড়া ভিড়, তিলধরার ঠাঁই নেই। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েও ছিলেন দর্শক। ভিড় সামাল দিতে শেষপর্যন্ত গেটও খুলে দেয়া হয়। এতো দর্শক চুয়াডাঙ্গায় জেলা প্রশাসক গোলকাপ ফুটবল টুনার্মেন্টে। গতকাল সোববার দ্বিতীয় রাউন্ডে স্বাগতিক চুয়াডাঙ্গা জেলা ফুটবল একাদশ বনাম টাঙ্গাইল জেলা ফুটবল একাদশ মুখোমুখি হয়। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন আহমেদ জেলা বাইরে থাকায় মাঠে প্রবেশ করতে বেশ দেরি হয়। ততোক্ষণে খেলা শুরু। খেলা শুরুর কিছুক্ষণ পর জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন আহমেদ মাঠে প্রবেশ করলেন। বাইরে অপেক্ষামান দর্শকদের ভিড় দেখে তিনি সব গেট খুলে দেয়ার জন্য বলেন। খুলে দেয়া হয় সব গেট। মাঠে গ্যালারিতে দর্শকদের উপচেপড়া ভিড়, হাজারো দর্শক গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে। সব মিলিয়ে জনসমুদ্রে পরিণত মাঠ। ধারণ ক্ষমতার অকেন বেশি দর্শক হওয়ায় পরে জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন আহেমদ মাঠে মধ্যে খেলা দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। একদিকে মাঠে উত্তেজনাপূর্ণ খেলা অন্যদিকে মাঠে হাজার হাজার দর্শক। সেসময় দর্শকদের হাততালি আর উচ্ছ্বাস। খেলা শেষে হাজারও জোনাকির আলো জ্বলছিলো যেন দর্শকের হাতের সব মোবাইলে। এদিকে দুপুর থেকে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগ পোয়াতে হয় দূরদূরান্তের চলাচলাকারী যানবাহন ও যাত্রীদের। খেলা শেষে হলে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা- মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে বেশি যানজটে পড়ে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কে। এ সড়কে চুয়াডাঙ্গা রেলগেট থেকে স্টেডিয়াম হয়ে হায়দারপুর তালবাগান পর্যন্ত যানবাহনের দীর্ঘলাইন দেখা যায়। আটকা পড়ে দূরপাল্লার বাস-ট্রাকসহ লোকাল বাস ও অটোবাইক। জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, মাঠে ২৫ হাজারের বেশি দর্শক খেলা উপভোগ করেছে। বর্তমানে জেলা বা জাতীয় পর্যায়ে কোনো খেলা এতো দর্শক সমাগম হয় না। তবে সাধারণ দর্শকরা বলেছেন মাঠে প্রায় ৪০ হাজার দর্শক খেলা উপভোগ করেছে।