বিসিবির বোনাস সংস্কৃতি নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন

মাথাভাঙ্গা মনিটর: ভারতীয় সাংবাদিক ভ্রু কুঁচকে টাকার অঙ্কটা আবার জিজ্ঞেস করলেন, কতো?  এক কোটি!  টাকার বণ্টনটা হবে কীভাবে? দলের প্রত্যেকেই পাবেন। টাকাটা কে দিলো, বিসিবি সভাপতি ব্যক্তিগতভাবে, নাকি বোর্ডের পক্ষ কে?ঘোষণা করেছেন বিসিবি সভাপতি, তবে সেটি দেয়া হবে বিসিবির কোষাগার থেকেই। প্রেমাদাসার নেটের সামনে ভারতীয় সাংবাদিকের বিস্ময়ের শেষ নেই! ভারত-শ্রীলঙ্কা দলও তো ম্যাচ জিতেছে নিদাহাস ট্রফিতে। কই, তাদের বোর্ড থেকে কোনো বোনাস-টোনাস ঘোষণা করা হলো না! ১৬ মার্চ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ‘সেমিফাইনালে’ রূপ নেয়া ম্যাচটা জেতার পরই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান কোটি টাকার বোনাস ঘোষণা করেছেন। খেলোয়াড়দের উদ্বুদ্ধ করতে বোনাস ঘোষণা হতেই পারে। কিন্তু প্রশ্নটা উঠেছে, সিরিজের মাঝপথে কেন? খেলোয়াড়দের উদ্বুদ্ধ করার একমাত্র উপায় বোনাস ঘোষণা, সেটিই-বা কোথায় বলা আছে!

ক্রিকেটারদের বোনাস দেয়ার রীতি বাংলাদেশের ক্রিকেটে পুরোনো। ক্লাব কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে গুরুত্বপূর্ণ বা রোমাঞ্চকর কোনো ম্যাচ জিতলেই বোনাস ঘোষণা করতে দেখা যায়। জাতীয় দলও ব্যতিক্রম নয়। গত বছর পি সারা ওভালে নিজেদের শততম টেস্টে জয়ের পর এক কোটি টাকা ঘোষণা করেছিলেন বিসিবি সভাপতি। অথচ তখনো বাংলাদেশ দলের শ্রীলঙ্কা সফর শেষ হয়নি। দুই কোটি টাকার বোনাস ঘোষণা করা হলো গত আগস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের মাঝপথে। এবার নিদাহাস ট্রফিতে বোনাস ঘোষণা করা হয়েছে ফাইনালের আগে।

আইসিসির টুর্নামেন্টে প্রাইজমানি থাকে। টাকাটা হস্তান্তর করা হয় টুর্নামেন্ট শেষে। বাংলাদেশ যেমন গত চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে উঠে চার কোটি টাকা পেয়েছিলো। বাংলাদেশ দল ভালো খেললে বিসিবি সভাপতি যে বোনাস ঘোষণা করেন, সেটি অবশ্য দ্রুতই পেয়ে যান খেলোয়াড়েরা। বিসিবির কোষাগার থেকে বেশির ভাগ সময় চেক দেয়া হয় খেলোয়াড়দের। খেলোয়াড়েরা বোনাস পান পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে, গ্রেডের ভিত্তিতে নয়। অনেক সময় বিসিবি সভাপতি বোর্ডের অনুমোদন বা পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজনও অনুভব করেন না বলে অভিযোগ আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক বোর্ড পরিচালক বললেন, খেলোয়াড়েরা বোনাস পেতে পারেন, তবে সেটি দেয়া উচিত সঠিক পদ্ধতিতে, ‘যেভাবে বোনাস ঘোষণা করা হয়, এভাবে না দিয়ে ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ প্রস্তাবনা আকারে বোর্ড মিটিংয়ে পাস করিয়ে নিতে পেরে। না হলে মনে হতে পারে, বোনাস নির্ভর করে বোর্ড সভাপতির খুশি-অখুশির ওপর। টাকার অঙ্ক যেহেতু নেহাত কম নয়, এ ধরনের আর্থিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পরিচালনা পর্ষদের মতামতের গুরুত্ব বা প্রতিফলন থাকা উচিত। হ্যাঁ, প্রেসিডেন্টের বোনাস ঘোষণার এখতিয়ার আছে। কিন্তু তার উচিত সহকর্মীদের যোগ্য সম্মান দেয়া, যেহেতু তিনি আগে পরিচালক, পরে সভাপতি। আমরা সবাই চাই, খেলোয়াড়েরা আর্থিকভাবে লাভবান হোক। সবই হোক নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে।’

একটা সময় খেলোয়াড়দের বোনাস দেয়ার বিষয়টি দেখত বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ। আগ থেকেই ঠিক করা থাকতো, কোন ম্যাচে জিতলে কতো টাকা বোনাস পাবেন খেলোয়াড়েরা। কিংবা র‌্যাঙ্কিংয়ের ওপরের দলকে হারালে কতো বোনাস থাকবে। আলাদা করে বোনাস ঘোষণার দরকার পড়ত না। ভালো খেললে খেলোয়াড়েরা এমনি পেয়ে যেতেন। এখন লিখিত নিয়ম নয়, বিসিবি সভাপতি যেকোনো সময় অবতীর্ণ হন বোনাস ঘোষকের ভূমিকায়। বিদেশি সাংবাদিকেরা যেমন এবারই ভেবেছিলেন, বোনাসটা বিসিবি সভাপতি নিজের ব্যাংক হিসাব থেকে দিচ্ছেন। এ নিয়ে বোর্ডের ভেতরে একটা অংশেরও আছে অসন্তোষ। যদিও বাংলাদেশে আর সব ক্ষেত্রের মতো বোর্ডেও গণতান্ত্রিক চর্চা নেই বলে কেউ এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন যেমন বললেন, ‘ক্রিকেট বিশ্বে পাকিস্তান বোর্ড নিয়ে হাসাহাসি হয়। পিসিবিতেও কিন্তু এতো হুটহাট বোনাস ঘোষণার সংস্কৃতি আমরা দেখি না। এছাড়া বাকি ক্রিকেট বিশ্বেও এভাবে বোনাস দেয়ার খবর পাওয়া যায় না। শ্রীলঙ্কা এই টুর্নামেন্টেই ভারতকে হারিয়েছে। এই টুর্নামেন্ট জেতা তাদের জন্য বেশি জরুরি ছিলো। কই, শ্রীলঙ্কান বোর্ড তো ক্রিকেটারদের বাড়তি বোনাস ঘোষণা দিলো না।’

তবে সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন মনে করেন, খেলোয়াড়দের প্রণোদনা দেয়া খারাপ নয়। শুধু তিনি প্রণোদনা দেয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিলেন। তার মতে, বোনাসের চেয়ে খেলোয়াড়দের বেতন কাঠামো আরও বাড়ানোয় মনোযোগ দিতে পারে বিসিবি। শুধু জাতীয় দল নয়, এর বাইরে থাকা সব স্তরের সব ক্রিকেটার যেন যোগ্যতার ভিত্তিতে সঠিক অঙ্কের পারিশ্রমিক পান, সেটি নিশ্চিত করা বেশি জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

জাতীয় দলের বাইরে চলে যাওয়া একজন ক্রিকেটার নিজের ফিটনেস ঠিকমতো ধরে রাখার মতো অবকাঠামোগত সুবিধাই সবসময় পান না। এগুলো ঠিক করা আরও বেশি জরুরি বলে মনে করেন সাবেক ক্রিকেটাররা। জেলা পর্যায়ের একজন ক্রিকেটারও যেন পেশা হিসেবে ক্রিকেটকে সম্মানজনক মনে করেন, সেদিকেও উৎসাহ বাড়ানো জরুরি। বাংলাদেশের বিভাগীয় জেলাগুলোতেও ক্রিকেটের আধুনিক অবকাঠামোগত সুবিধা নেই।

গাজী আশরাফ তাই বলছেন, ‘এ ধরনের প্রণোদনা দেয়ার বিপক্ষে নই। একজন ক্রিকেটারের খেলোয়াড়ি জীবন খুব দীর্ঘ নয়। শুধু জাতীয় দলের কেন, প্রণোদনা দেয়া উচিত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদেরও। যেটি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া দিয়ে থাকে। জিতলেই বছরে তিন-চার কোটি টাকার প্রণোদনা না দিয়ে এটা বেতন কাঠামোয় যোগ করলে আরও ভালো হয়। খেলোয়াড়েরা তাতে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হবে।’ বোনাস যে শুধু খেলোয়াড়কেই দিতে হবে, এমন নয়। গাজী আশরাফের যুক্তি, বোনাস দেয়া যেতে পারে অনেকভাবে, ‘বোনাসের অনেক ধরন হতে পারে। যে খেলেছে তাকে দিতে পারে। সে যে জেলা থেকে উঠে এসেছে, সেখানকার ক্রিকেট উন্নয়নেও একটা আর্থিক সুবিধা দেয়া যেতে পারে। ধরুন, মাশরাফি বিন মুর্তজা এসেছে নড়াইল থেকে। একটা সিরিজ বা টুর্নামেন্টে ভালো খেলার পুরস্কার হিসেবে বিসিবি নড়াইলের ক্রিকেট উন্নয়নে একটা আর্থিক সুবিধা দিতে পারে।’