পর্দা নামলো বিশ্বকাপের

 

স্টাফ রিপোর্টার: কোনটা সবচেয়ে বেশি শোকের?১৯৫০, না ২০১৪ বিশ্বকাপ। মারাকানা না বেলেহরিজোন্তের মিনেইরো?ব্রাজিলের সাধারণ মানুষের কাছে একটা পুরোনো ঘা, আরেকটা নতুন ঘা। ৬৪ বছরের পুরনো ঘা না শুকাতেই ব্রাজিল ফুটবলে আরেকটারক্তক্ষরণ। ব্রাজিলীয়দের কাছে বিশ্বকাপ ফুটবলটি শেষ হলো শোকে, হতাশায়।হৃদয়বিদারক বিশ্বকাপ ছিলো। ১৩ জুন সাও পাওলোর মাঠে ব্রাজিল ক্রোয়েশিয়ারলড়াইয়ে জয় দিয়ে যে অভিযান শুরু হয়েছিলো, সেটা শেষ হলো ব্রাজিলের রাজধানীয়ব্রাসিলীয়ায়। রক্তাক্ত হূদয়ে। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচেনেদারল্যান্ডসের কাছে হারলো ব্রাজিল ৩-০। আরেকটি লজ্জার হার। জয়-পরাজয় তোথাকবেই তাই বলে এমন হার দেখে ব্রাজিলের মানুষ কতটা হতাশ, তা চোখের পানিদেখলেই বুঝা যায়। মাঠে টিভির সামনে ব্রাজিলীয়দের কান্না দেখা গেছে।জার্মানির কাছে ২৯ মিনিটে ৫ গোল হজম করার দৃশ্য দেখে মানুষ কেঁদেছে। এইছবি দেখা গেলো ব্রাসিলিয়া, নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে। ২ গোল হজমের পরগ্যালঅরিতে দেখা গেছে একটা কোলের শিশু কান্নায় মাকে জড়িয়ে ধরলো। তরুণীচোখের পানি তার কাঁধে, গায়ের জামায়। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন অনেকফুটবল পরিবার।

স্বাগতিক দেশ এর আগে তিনবার তৃতীয় স্থান নির্ধারণীম্যাচ খেলেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক আসরগুলোতে কোনো দল ২ ম্যাচে ১০ গোলহজম করে খেলা শেষ করেনি। ব্রাজিলের এমন বিদায়ে মানুষ কতটা ব্যথিত, কতটাশোকাচ্ছন্ন তা বলে বুঝানো কঠিন। দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ মানুষের মধ্যেব্রাজিলের ফুটবল নিয়ে আলোচনা নেই। ফুটবল ব্যর্থতায় মানুষের মন শোকেআচ্ছন্ন হতে পারে। তা ব্রাজিলের মানুষের সাথে কথা না বললে বুঝা যেত কিনাজানি না। এখানে ফুটবল মানুষের আবেগে জড়ানো। এখানে মানুষের ধর্মটাই যেনফুটবলকে ঘিরে। যে শিশুটি আজ জন্ম নেয়। তাকে ফুটবলীয় কিছু উপহার দিতে হয়।আপনি যদি নবজাতককে দেখতে গিয়ে ফুটবলীয় কিছু না দিয়ে অন্য কোনো উপহারদিলেন, তাহলে মনে রাখবেন নবজাতকের পরিবারে আপনার কদর মুহূর্তেই নষ্ট হয়েযাবে। মনে করা হয় আপনি সেই শিশুটির মঙ্গল কামনা করেননি। সন্তান জন্ম হওয়ামানেই বাবা-মায়ের প্রথম পছন্দ তাকে ফুটবলার বানাবেন। জন্মের প্রথম দিনথেকেই শিশুর হাতে থাকবে ফুটবল। এটাই ব্রাজিলীয়ানদের কাছে সবচেয়ে বড় আদর্শ।সন্তান ফুটবলার হতে না পারলে তখন অন্য পেশায় যাবে। এটাই হচ্ছে ব্রাজিলেরমানুষের ফুটবল। টয়লের ইউরিনাল সিস্টেমের নেটে ফুটবলের জিজাইন। ঘরেরআসবাবপত্রে ফুটবলের ডিজাইন। রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিঙে ফুটবলীয়অঙ্কন। পাহাড়ের ওপরে ফুটবল মাঠ। পাহাড়ের নিচেও ফুটবল মাঠ। পাড়ায় পাড়ায়ফুটবল মাঠ। ঘরের আঙিনায় ফুটবল। সেই আবেগের ফুটবল। ভালোবাসার ফুটবলতাদেরকে এতোটা আঘাত করবে, তা স্বপ্নেও ভাবেননি ব্রাজিলীয়ানরা। ব্রাজিলেরমানুষের কাছে ব্যথার বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে। ব্রাজিলের মানুষের কাছে এ যেনশোকের বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে। যেখানে বিশ্বকাপ বিদায়ের বিউগলে আবেগ আপ্লুতহওয়ার কথা। সেখানে হয়েছে তার উল্টো। এখনও জার্মানির সোয়াইনস্টাইগার, থমাসমুলার, ওজিল, মিরোস্লাভ ক্লোসা, টনিক্রুজ, আন্দে স্কুলেরা ব্রাজিলেরথিয়েগো সিলভা, ডেভিড লুইস, রামেরি, অসকারদের চোখে ভাসছে। ঘুমের ঘোরেওদেখছেন জার্মানির গোল উত্সবের উল্লাস। তা হলে কেনই নেদারল্যান্ডসের কাছেওএমন পরিস্থিতি হবে। যেখানে নেইমারের খেলা দেখতে যাওয়ার কথা। সেখানে চোটপাওয়া নেইমারকে জার্সি প্যান্ট পরিয়ে খেলোয়াড়দের সাথে মাঠে বসিয়ে দেয়হলো। কেন?নেইমার তো খেলবেন না। তাকে কেন মাঠে রাখতে হলো?নেইমার মাঠেথাকলে দল ভালো খেলবে। মানসিক শক্তিটা বাড়বে। এসব আবেগ দিয়ে ফুটবল খেলা হয়না। সেটা দিন শেষের আগেই ৩-০ স্কোর লাইন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেনেদারল্যান্ডস। ৫৮, ৬২, ৭০, ৯৮ এবং ২০০২ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল এবারঘরের মাঠে ২০তম বিশ্বকাপের আসরে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করেছে। তৃতীয়স্থানও পায়নি। চতুর্থ হয়ে কোচ স্কোলারির ছেলেরা বাড়ি ফিরলো। ফাইনালখেললো আর্জেন্টিনা জার্মানি।

বিশ্বকাপ বিদায়ের কথা বলতে গিয়েব্রাজিলে আসা সংবাদকর্মীরদের কণ্ঠেও ব্রাজিলের ব্যর্থতার কথাই ঠাঁই পাচ্ছে।এশিয়ার দলগুলো কোন ফাঁকে বিদায় নিলো তা কেউ খেয়ালই করলো না। স্পেন, ইংল্যান্ড, ইতালী, পর্তুগালের মতো দলগুলা কীভাবে বিদায় নিলো, সেই আলোচনারটেবিলটা বড় হতে পারলো না। ট্রফি জয় করতে আসা দেশগুলোর বিদায়ের রেশ নাকাটতেই আবার সেই ব্রাজিল ব্যর্থতার প্রসঙ্গ উঠে আসছে। ফার্স্ট ফুডের দোকানথেকে শুরু করে মারাকানায় সংবাদ সম্মেলনের টেবিলেও অনুপ্রবেশ। আবার সেই একইপ্রসঙ্গ। সমাপণীর অনুষ্ঠান নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংশ্লিষ্টপ্রসঙ্গটি পিছিয়ে ঠাঁই পেলো ব্রাজিলের ব্যর্থতা। মেক্সিকান, আর্জেন্টাইন, ব্রাজিলয়ান পপ স্টাররা ব্যর্থতা নিয়ে কথা বললেন। বলতে হলো সঙ্গীত শিল্পীশাকিরাকেও। শিল্পীদের কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন থিয়েগো সিলভাদের। সাধারণমানুষদের উদ্দেশে বলছিলেন, আমাদের সাফল্যের ভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ। আমরাতো ৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। যখন তুমি হাসতে পারবে, মনে রাখবে তখনই তুমিচ্যাম্পিয়ন হতে পারবে। আবার কেউ বলছিলেন হার-জিত থাকতেই পারে। তাই বলে এমনলজ্জা তো আমরা পেতে চাইনি। বলছেন আগামীতে ৫ বিশ্বকাপে ব্রাজিল ট্রফিজিতলেও নাকি জার্মানিকে ভুলতে পারবে না ব্রাজিলের সাধারণ মানুষ।

ব্রাজিলেরপ্রসঙ্গ থেকে সরে আসলে এবারের বিশ্বকাপে চিলি, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ডেরকথাও মনে রাখবে সবাই। বিশ্বকাপ ফুটবলের তরুণ ফুটবলার নেদারল্যান্ডসেরমেমফিস ডিপে, ফ্রান্সের পল এবং রাফালের নাম উঠে এসেছিলো। আলোচনায় না থাকাআর্জেন্টিনার গোলিকপার সার্জেই রামোরিও সেরাদের তালিকায় উঠলেন। ছিলেনজার্মানিরি মানুয়েল। সেরা খেলোয়াড়দের তালিকায় ছিলেন নতুন তারকা কলম্বিয়ারজেমস রডরিগুয়েজ। ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবলের নবাগত দল বসনিয়া হার্জেগোভিনাআলোচনায় না থাকলেও প্রথম এসেই লজ্জায় ফেলেনি তারা। আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে২-১ গোলে হেরেছে। আর্জেন্টিনার মতো দলের বিরুদ্ধে গোল করতে পারাও তো কমনয়। নাইজেরিয়াকে ধরেই ফেলেছিলো, হেরেছে মাত্র ১-০ গোল। ইরানের কাছে ৩-১গোলে হেরেছে। তিন ম্যাচেই তিন গোল করেছে। গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়াবসনিয়া হার্জেগোভিনা বিশ্বকাপ ফুটবলের আলোচনায় থাকল। কবে বাংলাদেশেরফুটবল এমন আলোচনায় থাকবে?