চ্যাম্পিয়ান ট্রফি থেকে বিদায়ের পথে বাংলাদেশ : বৃষ্টিবাধায় অস্ট্রেলিয়া

 

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়া। ওভালে তো আসলে কাল অন্য দুটি ম্যাচ হলো। একটির নাম অস্ট্রেলিয়া বনাম তামিম ইকবাল। অন্যটির অস্ট্রেলিয়া বনাম বৃষ্টি! বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো দ্বিতীয়টাই। তাতে কে জিতলো? এই প্রতিবেদন লেখার সময় এগিয়ে ছিলো বৃষ্টি। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের ১৬ ওভার পরই যা খেলা থামিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া প্রার্থনা করছে বৃষ্টি-দেবতার কাছে। কোনোমতে আর চারটি ওভার হলেই তাদের হয়ে যায়। ডাকওয়ার্থ-লুইসের হিসাব যা দাবি করে, রান এরই মধ্যে তার চেয়ে অনেক বেশি।

‘অস্ট্রেলিয়া বনাম বৃষ্টি’ না হয় এখনো ফলের অপেক্ষায়। কিন্তু প্রথমটিতে কী হলো…অস্ট্রেলিয়া বনাম তামিম? সেঞ্চুরিটা হলে তামিম ইকবালকে বিপুল ব্যবধানে জয়ী ঘোষণা করে দেয়া যেতো। হয়নি, তাতেই বা কী! তারপরও তো তামিমই জয়ী।

আশির দশকে বিটিভিতে একটা ধারাবাহিক নাটক তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিলো। নাম ভাঙনের শব্দ শুনি। যেটি দিয়ে বাংলাদেশের দর্শকেরা হুমায়ুন ফরীদির মাহাত্ম্য প্রথম বুঝেছিলো। ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ মনে হতে পারে, তবে তামিমের ইনিংসটা দেখতে দেখতে সত্যি মনে হচ্ছিলো, চারপাশ থেকে অস্ট্রেলিয়ানদের কিচিরমিচির ছাপিয়ে তিনিও ভাঙনের শব্দ শুনছেন। অন্য প্রান্তে ব্যাটসম্যান আসছেন আর যাচ্ছেন আর তিনি বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছেন একা। মাত্র ৫ রানের জন্য সেঞ্চুরি হারানোর দুঃখ থাকবে, তবে অনেক সেঞ্চুরির চেয়েও দামি এই ৯৫। পরিস্থিতি, বোলিং এ সবেই তো ইনিংসের মূল্য বাড়ে-কমে। সাকিবের সাথে ৬৯ রানের একটা জুটি হয়েছে। মিরাজের সাথে ২৮ রানের। শুধু এঁরা দুজনই তামিমের সাথে একটু দাঁড়াতে পারলেন। তামিম ছাড়া বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দুই অঙ্কের রানও শুধু এই দুজনেরই। বাকিদের রান পাশাপাশি লিখলে একটা টেলিফোন নম্বর হয়ে যায়!

বাংলাদেশের ইনিংস শেষেই উইকেটের ওপর ঢাকনা বসেছে। অনেকক্ষণ ধরেই কালো হয়ে থাকা আকাশ যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করেছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রেক্ষাপটে ‘অস্ট্রেলিয়া বনাম বৃষ্টি’ ততোক্ষণে দেখা দিয়েছে মহা তাৎপর্য নিয়ে। বিকেলে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দেখে ম্যাচ শুরুর আগেই নতুন এক সমীকরণ এসে উপস্থিত। এই ম্যাচে মীমাংসা না হলে অস্ট্রেলিয়ার ঘোর বিপদ আর হঠাৎই দপ করে জ্বলে উঠবে বাংলাদেশের নিবু নিবু সম্ভাবনার প্রদীপটা। শর্ত একটাই, শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারাতে হবে আর ইংল্যান্ডকে জিততে হবে বাকি দুটি ম্যাচ। তাহলেই বাংলাদেশ সেমিফাইনালে!

উইকেট থেকে ঢাকনা সরানোর সময় গ্যালারি থেকে সাধারণত একটা হর্ষধ্বনি ওঠে। পকেটের টাকা খরচ করে টিকিট কিনে মাঠে আসার পর কে-ইবা বৃষ্টি দেখতে চায়! কিন্তু এখানে দর্শকেরা কিনা উল্টো ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে…’ গান গাইছে! বৃষ্টি থামার পর অস্ট্রেলিয়া যখন ব্যাটিং করতে নেমে গেল, তাদের মন খারাপ। ভৌগোলিকভাবে ওভালের গ্যালারি, কিন্তু আসলে তো ‘মিরপুর’! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচেও গ্যালারির বড় একটা অংশের রং লাল-সবুজ হয়ে ছিলো। তবে সেদিন পুরো গ্যালারিই এমন ‘বাংলাদেশ’ হয়ে যায়নি।

বাংলাদেশের ১৮২ এই অস্ট্রেলিয়ার কাছে কোনো ব্যাপারই হওয়ার কথা নয়। ব্যাটিং করতে নামার সময় এই সংখ্যাটা তাদের মাথায় ঘুরছিলো বলেও মনে হয় না। স্টিভ স্মিথের দলের এক-দুই-তিন নম্বর চাওয়া তখন একটাই—কোনোমতে যেন ২০ ওভার খেলা হয়! বাংলাদেশ এতো কম রান করেছে যে, কোনো উইকেট না পড়লে ২০ ওভারে ৪১ রান করলেই জিতে যাবে অস্ট্রেলিয়া। ১ উইকেট পড়ে গেলে আর ৭ রান বেশি করলেই চলবে। ২ উইকেট পড়ে গেলে লাগবে ৫৮। যতো না মোস্তাফিজুর-মাশরাফিকে খেলছিলেন ওয়ার্নার-ফিঞ্চ, তার চেয়ে বেশি বৃষ্টি নামের অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে।

বাংলাদেশকে অবশ্য এই মুহূর্তে তর্কযোগ্যভাবে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে ভীতিকর বোলিংকেই খেলতে হলো। সেই বোলিং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এমনই ছন্নছাড়া রূপে দেখা দিয়েছিলো যে, ম্যাচ শেষে অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ প্রকাশ্যেই বলে দেন, এটা তার দেখা অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বাজে বোলিং পারফরম্যান্স। এতে যে কাজ হয়েছে, সেটি এই ম্যাচের আগে নেটেই টের পেয়েছেন। স্টার্ক-কামিন্স-হ্যাজলউডরা অধিনায়ককেও কোনো ছাড় দেননি। গতি আর বাউন্সারে দুর্বিষহ করে তুলেছেন স্মিথের জীবন।

সেই পারফরম্যান্স ম্যাচেও টেনে আনলেন তাঁরা। যদিও তাতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দায় যে একেবারে নেই, তা নয়। সৌম্য যেভাবে আউট হলেন, বা ইমরুল কায়েস, তা শুধু বোলিংয়ের মাহাত্ম্য নয়। উইকেটে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান বলে ৩৫তম ওভার পর্যন্ত লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পাকে দর্শক বানিয়ে রেখেছিলেন স্মিথ। বোলিংয়ে এসেই সেই জাম্পার পরপর দুই ওভারে ২ উইকেট। সাব্বির যে বলটায় আউট হলেন, তাতে আসলে ‘বাউন্ডারি’ লেখা ছিলো! উল্টো ওয়াইড হাফ ভলিতে এক্সস্ট্রা কাভারে ক্যাচ দিয়ে দিলেন। মাহমুদউল্লাহকে ফিরিয়ে দেয়া বলটাও এমন কিছু ছিলো না।

মাশরাফি বিন মুর্তজা বছর দুয়েক ধরেই একটা কথা বলেন। এই ম্যাচের আগেও বলেছেন। বিশ্বে এখন যতো বোলার আছে, তার মধ্যে শুধু দুজনই আলাদা। মিচেল স্টার্ক ও মোস্তাফিজুর রহমান। কালকের ম্যাচ দুজনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল রোমাঞ্চকর এক সন্ধিক্ষণে। মোস্তাফিজুর ব্যাটসম্যান। স্টার্ক বোলার এবং তিনি হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে। আগের দুই বলে মাশরাফি ও রুবেলকে আউট করেছেন। তবে গ্যালারিকে স্তব্ধ করে দেয়ার কাজটা করেছেন প্রথম বলেই। লেগ স্টাম্পের ওপর শর্ট বল, এক পা তুলে তামিমের বিখ্যাত সেই পুল, কিন্তু গ্যালারিতে যাওয়ার বদলে তা লং লেগের হাতে! স্টার্কের হ্যাটট্রিক হয়নি, তবে ‘ট্রিপল উইকেট মেডেন’ নিয়ে বাংলাদেশের ইনিংসের শেষটা রীতিমতো ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’ করে দিলেন!’

তামিম যেভাবে খেলেছেন, তার সেঞ্চুরি না পাওয়াটা চরম অবিচার। তবে ক্রিকেট তো মাঝেমধ্যে এমন করেই। তামিমের সঙ্গেও এই প্রথম করল না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চতুর্থবারের মতো নার্ভাস নাইনটিজে আউট হলেন। তিনবার ওয়ানডেতে, টেস্টে একবার। কী আশ্চর্য, প্রতিবারই কিনা ৯৫ রানে! ‘৯৫’ সংখ্যাটাকে নিশ্চয়ই মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে শুরু করেছেন তামিম!