রহমান মুকুল/শরিফুল ইসলাম: আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলাটি এখনও বেশ জনপ্রিয়। শ শ বছর ধরে আলমডাঙ্গা ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে এই লাঠিখেলা। কালের বিবর্তনে মানুষ ভুলতে বসেছে এ খেলা। বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শক্তিশালী অংশ লাঠিখেলা নিয়ে মানুষের এখনও যথেষ্ঠ আগ্রহ আছে। কিন্তু লাঠিখেলার নতুন করে কোনো সংগঠন বা দল তৈরি হচ্ছে না। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা। একদিকে ঢোল-ঢাকি আর লাঠির তালে তালে নাচানাচি। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের হাত থেকে আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বনের প্রচেষ্টা সংবলিত টান টান উত্তেজনাকর একটি খেলার নাম লাঠিখেলা। এ খেলা একটি ঐতিহ্যগত মার্শাল আর্ট, মূলত ঢাকের বাজনা, বিশেষ ধরনের শারীরিক মুদ্রা, শারীরিক কসরত, দ্যোতনা আর লাঠি এগুলোর সংমিশ্রণ এ খেলা। লাঠিখেলার এ বিশেষ ধরনের নাচের মুদ্রা আসলে আমাদের মাটি থেকে উৎসরিত সবচে আদিম নাচের মুদ্রা কি-না তা গবেষণারও দাবি রাখে। এ খেলার প্রারম্ভ নৃত্যকে পাঁয়তারা বলা হয়ে থাকে। সম্ভবত এ থেকেই বাংলা প্রবাদপ্রবচন পাঁয়তারা ভাজার প্রচলন হয়ে থাকবে।
লাঠিখেলা অনুশীলনকারীকে লাঠিয়াল বলা হয়। এই খেলার জন্য লাঠি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা, তবে প্রায় তৈলাক্ত হয়। প্রত্যেক খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করেন। সাধারণত বলিষ্ঠ যুবকরাই এই খেলায় অংশ নিয়ে থাকে। প্রত্যেক দলে একজন করে দলনেতা থাকেন। লাঠিখেলার আসরে লাঠির পাশাপাশি যন্ত্র হিসেবে ঢোলক, ঝুমঝুমি ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় এবং সঙ্গীতের পাশাপাশি এক ধরনের নৃত্য দেখানো হয়। এক সময় আলমডাঙ্গা অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই ২/৪ জন নামজাদা লাঠিয়াল ছিলো। এ খেলাটি দিন দিন বিলুপ্ত হওয়ার কারণে এর খেলোয়াড় সংখ্যাও এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। এ খেলার প্রচলন না থাকায় তৈরি হচ্ছে না কোনো নতুন খেলোয়াড়। পুরোনো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের মধ্যে বেশির ভাগই এখন প্রয়াত। যারা বেঁচে আছেন তারাও বয়সের ভারে ন্যূয়ে পড়েছেন। আলমডাঙ্গা অঞ্চলে নামজাদা খেলোয়াড়দের মধ্যে এখন জীবিত আছেন শুধুমাত্র পাঁচলিয়ার মকবুল হোসেন। তিনিও এখন বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত।
আমাদের অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের লাঠিখেলা রয়েছে। তবে তার মধ্যে অন্যতম সড়কি খেলা ও ডাকাত খেলা। এছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে ফড়ে খেলা, বানুটি খেলা, গ্রুপ যুদ্ধ, নড়িবারী খেলা এবং দা খেলা (ধারাল অস্ত্র দিয়ে উপহাস যুদ্ধ) খেলা ইত্যাদি খেলারও প্রচলন রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের নৈমিত্তিক জীবনের উৎসব বাংলা বর্ষবরণ, নবান্নসহ বিভিন্ন উপলক্ষে লাঠি খেলার আয়োজন করে থাকেন। এক্ষেত্রে সাধারণত কোনো লাঠিয়াল দলকে ভাড়া করে আনা হয়। বিগত দশকেও গ্রামাঞ্চলের লাঠিখেলা বেশ আনন্দের খোরাক জুগিয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় কালে-ভাদ্রে এ লাঠিখেলা দেখা গেলেও তা খুবই সীমিত। নির্মল বিনোদনের খোরাক গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এ লাঠিখেলাটি আর চোখে পড়ে না বললেই চলে। সংস্কৃতিমনা মানুষের দাবি- অবিলম্বে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এ লাঠিখেলা নতুন করে চালুর উদ্যোগ গ্রহণের।