সময়ের অতল গহ্বরে হারাচ্ছে দেশি যন্ত্র : সর্বত্রেই প্রযুক্তি

দামুড়হুদা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কৃষি কাজে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া

 

damurhuda  pic. 29.06.15 (2)

বখতিয়ার হোসেন বকুল: এভাবে বদলায় সময়। সময়ের অতল গহ্ববরে হারিয়ে যাচ্ছে যেভাবে গরুতে টানা লাঙল, বিদে। কৃষকের ঘরে ঘরে থাকা ঢেকি। শহরের রাস্তায় রাস্তায় প্যাডেল ঘুরিয়ে মানুষ হয়ে মানুষ টানা রিকশার বদলে যেভাবে এসেছে ব্যটারি চালিত অটো।

চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার সচেতন মহল এলাকার বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে তাকিয়ে যন্ত্রচালিত লাঙল বিদে দেখে উপরোক্ত মন্তব্য করে বলেছে, দেশের অন্য এলাকার মতো দামুড়হুদার কৃষকদের মধ্যেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। এলাকার প্রবীণ কৃষকদের অনেকেই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে স্মৃতি হাতড়ে বললেন, কাকডাকা ভোরে টোকা মাথায় দিয়ে হালের গরু, লাঙল, জোয়াল মই নিয়ে কৃষক ধেয়ে চলেছে মাঠে এরকম দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে আর সময়ের প্রয়োজনে পালাক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে মানব সভ্যতার অতীত ঐতিহ্য আর নানা আবিষ্কারের ইতিহাস। এরই একটি হচ্ছে লাঙলের হালচাষ পদ্ধতি। মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে কাঠের তৈরি লাঙলই ছিলো জমি চাষের একমাত্র পদ্ধতি। বর্তমানে আধুনিক সভ্যতার যুগে বিজ্ঞানের নিরন্তর প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে আধুনিক নানা কৃষিযন্ত্রপাতি। উন্নত কৃষি পদ্ধতির ভিড়ে টিকে থাকতে পারছে না সেকেলের সেই লাঙলের হালচাষ পদ্ধতি। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন আর দেখা যায় না গরুটানা লাঙলের হাল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আদিম মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে শিকারের নেশায় ঘুরে বেড়াতো বনে-জঙ্গলে। একসময় তারা দেখতে পেলো বন-জঙ্গলে বিভিন্ন ফলজ, বনজ, ওষুধিসহ নানা প্রজাতির ফলের বীজ মাটিতে পড়ে ও পশুপাখির বিষ্ঠায় থাকা বীজ হতে অনুরূপ আরেকটি গাছের জন্ম হতে। এ দেখে তারা অনুভব করলো বন-জঙ্গলে ঘুরাফেরা না করে এক জায়গায় সংঘবদ্ধভাবে স্থায়ী বসবাসের। স্থায়ীভাবে বসবাসের শুরুতেই নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে এক সময় তারা বনজঙ্গল হতে বিভিন্ন খাদ্যশস্যের বীজ সংগ্রহ করে নিজেদের তৈরি শক্ত ধাতব বস্তুর মাধ্যমে মাটি খুড়ে ফসল ফলাতে শিখলো। এরই এক পর্যায়ে কাঠের তৈরি চাঁদ আকৃতির লাঙল ও তাতে পশুর ব্যবহারের মাধ্যমে জমিচাষ করে এক ধাপ এগিয়ে নবসভ্যতার যুগে প্রবেশ করলো তারা। সে থেকে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত বিশ্বময় চলে আসতে থাকে ওই চাষপদ্ধতি। আমাদের দেশে ৯০ দশক পর্যন্ত ওই হালচাষ পদ্ধতি ছিলো কৃষি উৎপাদনের একমাত্র উপায়। হালচাষিরা ভোররাতে উঠে হালের গরু, কাঁধে লাঙল, পোয়ালের তৈরি মুড়ায় আগুন ধরিয়ে জোয়াল মই নিয়ে ধেয়ে চলতো মাঠে এ দৃশ্য ছিলো প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে। তাদের নাওয়া-খাওয়া হতো ক্ষেতের আঁইলে বসেই। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভোর থেকে বেলা গড়া পর্যন্ত চলত তাদের হালচাষ। পাড়ার গৃস্থস্তরা মিলে গাতা করে পালাক্রমে একে অপরের জমিচাষ করতো। লুঙ্গির ট্যারে গুঁজে রাখতো বিড়ির প্যাকেট। নাওয়া-খাওয়া সেরে মনের সুখে টানতো বিড়ি। তাদের সেই কর্মব্যস্ত জীবনকাহিনী আজ নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটাই কল্পকাহিনী। আমাদের দেশে আশির দশকের শুরুতে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার শুরু হলেও নব্বই দশকের পর থেকে বাড়তে থাকে এর ব্যবহার। ওই সময় থেকেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ণমূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শিল্প-বাণিজ্য ও পরিবহণ খাতে ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকায় কৃষিকাজে দেখা দিতে শুরু করে শ্রমশক্তির অভাব। শ্রমশক্তির অভাবে একদিকে যেমন বেড়ে গেলো শ্রমের মজুরি অন্যদিকে কৃষি যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতার ফলে চাষিরা শ্রমশক্তির পরিবর্তে শুরু করে কৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার। ঝুঁকে পড়লো ইঞ্জিনচালিত মেশিনের দিকে। জমিচাষ, ফসল মাড়াই, বস্তাবন্দি, রোপণ, নিড়ানি, সার প্রয়োগসহ ফসল কাটা পর্যন্ত সবকাজেই আধুনিক কৃষিযন্ত্রপাতির ব্যবহার। ক্রমাগতভাবে বদলাতে শুরু করলো কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষিকাজের চিরায়ত রূপ।

এ বিষয়ে দামুড়হুদা দশমীপাড়ার কৃষক আকবার আলী বলেন, কৃষিকাজে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে সময় ও শ্রম দুটোই কম লাগে। তাছাড়া ফসলের অপচয়ও হয় কম। এ প্রসঙ্গে দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি অফিসার সুফি মো. রফিকুজ্জামান বলেন, বর্তমান সরকার কৃষিসেবা কৃষকের দৌড় দোড়ায় পৌছে দিতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কম জমিতে অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষকদের নানা পরামর্শও দেয়া হচ্ছে। কৃষি কাজে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রম-ঘাম অপচয় রোধসহ শস্য উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। কৃষকের চাহিদার প্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি তৈরির এক সৃজনশীল পরিবেশ। কৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে কৃষকের আদি ঐতিহ্য। আজকের প্রজন্মের সেই আদি ঐতিহ্য গরুটানা লাঙলের হালের সাথে পরিচয় নেই বললেই চলে। লাঙলের হাল দেখতে হয়তো বা একদিন এই নতুন প্রজন্মকে যেতে হবে মেলায় কিংবা জাদুঘরে।