শিশু আদুরী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে কাল

স্টাফ রিপোর্টার: আদুরী কাল বাড়ি ফিরবে। প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে আলো ঝলমল রূপনগরী ঢাকায় এসেছিলো সে। সেই রূপনগরী রাজধানী রূপ তাকে না রাঙিয়ে দিনের পর দিন নরক যন্ত্রণা দিয়েছে। গৃহকর্ত্রীর নৃশংসতায় জীবন্ত কঙ্কাল অবস্থায় মাস খানেক আগে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ৯ বছরের আদুরীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। ওই সময় তার পুরো শরীরে যে ধরনের মধ্যযুগীয় বর্বরতার চিহ্ন ছিলো তা দেখে হাসপাতালে থাকা ডাক্তার, নার্সসহ সবাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আত্মীয়স্বজন দেখে ভয়-ভীতিতে আতঙ্কিত হয়ে কেঁদে ওঠেন। এখন আদুরী সুস্থ, কাল রোববার এ রাজধানী ছেড়ে চলে যাবে পটুয়াখালীর বাউফলের জৈনকাঠি গ্রামে। যে গ্রামে সে ৭ বছর পর্যন্ত বেড়ে উঠেছিলো। আজ আদুরীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আদুরী রাজধানীর একটি বাসায় প্রায় ৩ বছর ধরে গৃহকর্মীর কাজ করতো। গৃহকর্ত্রীর নৃশংস নির্যাতনের শিকার আদুরীকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীতে ময়লার স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর কঙ্কালসার শরীরে অসংখ্য চিহ্ন নিয়ে আদুরীকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরই মধ্যে নিযার্তনকারী গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ।

শুক্রবার দুপুরে ওসিসিতে আদুরীর খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, সে সমবয়সী শিশুদের সাথে খেলছে। নতুন জামা-কাপড় পরা আদুরীর কানে দুল, হাতে মেহেদির রঙ। হেসে বলছিলো, আমি কাল (রোববার) গ্রামের বাড়িতে যাব। সবার সাথে দেখা হবে, অনেক মজা হবে, ওই বাসায় আর যাব না। এখানে (রাজধানী) আর জীবনেও আসব না। হাতে লাগানো মেহেদি দেখিয়ে শিশু আদুরী বলে, গ্রামে গিয়ে সবাইকে দেখাব, নদীতে গোসল করব। এরই ফাঁকে ওসিসিতে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি আদুরির সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেন, হাত ধরে শিশুদের মতো খেলা করারও চেষ্টা করেন।

এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপকালে পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আদুরীর প্রতি তার ভালোবাসা অনেক। শিশু বিভাগ ছাড়াও হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা আদুরীকে ভালোবাসে। আদুরীকে দেখতে আসে। আদুরীকে প্রতিদিনই দেখতে আসেন এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, শিশুটিকে আল্লাহই ভালো করেছেন। কোনোদিন ভাবতে পারিনি এ শিশুটি বেঁচে উঠতে পারবে। জানালেন, ভর্তির দিন থেকে ৩ দিন পর্যন্ত আদুরী অজ্ঞান ছিলো। শরীরের ক্ষত থেকে রক্ত আর পুঁজ পড়ছিলো। পুরো শরীরের চামড়া হাড়ের সাথে লেগে গিয়েছিলো। শরীরে ধরতেই চামড়া খসে আসত। শিশুটিকে বাঁচাতে সামগ্রিকভাবে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ নেয়া হয়েছিলো। হাসপাতালে থাকা সব বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে ৫-৬ বার চিকিৎসা বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা করানো হয়েছে। ভর্তির সময় তার ১৬ কেজি ওজন ছিলো। বর্তমানে সে ২৬ কেজি ওজন নিয়ে বাড়ি ফিরছে। চিকিৎসা অবস্থায় তার প্রায় ১০ কেজি ওজন বেড়েছে। উন্নত খাবার খাওয়ানো হয়েছে তাকে। কিনে দেয়া হয়েছে নতুন জামা-কাপড়, হাতের চুড়ি, কানের দুল, নাকফুলসহ বিভিন্ন প্রসাধনী।

পরিচালক জানান, তার নামে ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। অ্যাকাউন্টের মধ্যে তাকে সাহায্য পাঠানোরও অনুরোধ করেন তিনি। আজ আদুরীকে হাসপাতালের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানানো হবে। দেয়া হবে উপহারসামগ্রীও। আদুরী যেকোনো সমস্যায় ডাক্তাররা তারে পাশে থাকবেন বলেও তিনি জানান। ওসিসির সমন্বয়ক ডা. বিলকিস বেগম বলেন, আদুরী সবসময় আদর পেতে ভালোবাসে। কেউ আদর করলে সে অনেক খুশি হয়। মেহেদি, আলতা লাগিয়ে নাচে। আবার যখন কেউ তার নির্যাতনের কথা বলে তখন কেঁদে ওঠে। আদুরীর মা সাফিয়া বেগম জানান, স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তার মেয়ে বেঁচে যাবে। হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা তার মেয়ের জন্য অনেক করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, নির্যাতনকারী গৃহকর্ত্রী গ্রেফতার হয়েছে কিন্তু তাতে তার কী লাভ হয়েছে। তার মেয়ের ওপর যে অত্যাচার নির্যাতন করা হয়েছে। তার কী হবে। মেয়ে সুস্থ হলেও পুরো শরীরেই নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। এমন নির্যাতন আর কোনো শিশুর প্রতি যেন না হয় এমন নিশ্চয়তা চান আদুরীর মা সাফিয়া বেগম।