বিজয় বন্দনা

১৪ ডিসেম্বর : কলঙ্কময় দিন

তানভীর ইমাম

১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আজ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে আরেক বেদনাদায়ক দিন। পাকবাহিনীর সঙ্গে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় যখন নিশ্চিত, ঠিক তখন ১৯৭১ সালের এদিনে হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের রাতের আঁধারে চোখ বেঁধে বাসা থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতাবিরোধী এ চক্রটি বুঝতে পেরেছিলো পরাজয় তাদের অনিবার্য। তারা বুঝতে পেরেছিলো জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে এদেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে। তাই পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। পাকিবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা এ বর্বর হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর পরই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিকটাত্মীয়রা এসব স্থানে গলিত ও ক্ষত-বিক্ষত লাশ খুঁজে পায়। লাশের গায়ে ছিলো আঘাতের চিহ্ন। চোখ, হাত-পা ছিলো বাঁধা। কারও কারও শরীরে ছিলো একাধিক গুলি। কারও চোখ ওপরে ফেলা হয়েছে। অনেককে হত্যা করা হয়েছিলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে। লাশের ক্ষত চিহ্নের কারণে অনেকেই তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এসব বুদ্ধিজীবী মেধা, মনন ও তাদের লেখনির মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠক ও মুক্তিকামী বাঙালির প্রেরণা জুগিয়েছেন। আর সেটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য। এসব বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর তালিকা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র সংগঠন কুখ্যাত আলবদর ও আলশামস বাহিনী। পেছন থেকে মদদ জোগায় এদেশের দায়িত্বে থাকা পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের এ হত্যাকাণ্ড ছিলো পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিলো। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন (জাতীয়ভাবে), পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখায় উল্লেখ রয়েছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। অবশ্য পরবর্তীকালে এ সংখ্যা আরও বেশি বলা হয়েছে বিভিন্ন জার্নালে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ৭১’র ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০ হাজারের মতো বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলো। কিন্তু বিজয় সন্নিকটে হওয়ায় পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তথ্যে জানা যায়, ফরমান আলীর টার্গেট ছিলো শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে দাওয়াত করে নিয়ে যাওয়া এবং সেখানেই তাদের মেরে ফেলা। ওই সময় বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান (বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার) বলেছিলেন, এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত হেনেছে। উল্লেখ্য, কমিশনের আহ্বায়ক জহির রায়হান নিখোঁজ হন ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। জহির রায়হান তার অগ্রজ সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের সন্ধানে মিরপুর বিহারি পল্লীতে যাওয়ার পর নিখোঁজ হন বলে উল্লেখ রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, মিরপুর মুক্ত হয় ৩১ জানুয়ারি। তার আগে এ অঞ্চলটি ছিলো আলশামস বাহিনীর দখলে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু তার এ সিদ্ধান্তটি আলোর মুখ দেখেনি।

বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন প্রণীত একটি দলিলে উল্লেখ রয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যায় যারা ভূমিকা রাখে তাদের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রাজা, ব্রিগেডিয়ার আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্নেল তাজ, কর্নেল তাহের, ভিসি প্রফেসর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, ড. মোহর আলী, আল বদরের শীর্ষ নেতা এবিএম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীন। মূল নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। ১৪ ডিসেম্বরের মাত্র ১০ দিন আগে (৪ ডিসেম্বর) ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে। ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়।

সেদিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ রাজধানীর বহু স্থানে স্থাপিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ওপর বর্বর ও বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের হত্যা করে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ লড়াই করে ত্রিশ লাখ শহীদ ও তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনেন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। পৃথিবীর মানচিত্রে সগৌরবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশের মানচিত্র।

ইতিহাসের খেয়াখাতায় দেখা যায়, বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা প্রস্তুতে সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের পেছনে ছিলো মূলত জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিলেন বদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যার দুটি পৃষ্ঠায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের বাসস্থানের নম্বর লেখা ছিলো। তার গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের দেয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী রায়েরবাজারের বিল ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি থেকে কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ পাওয়া যায় যাদের আশরাফুজ্জামান নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে।

আর পূর্ব দেশের সাংবাদিক চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ’৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলো। মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দু’জনের অপরাধ চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। বিদেশে পালিয়ে থাকায় তাদের রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে তাদের এ দেশীয় সহযোগী ও শীর্ষ রাজাকার গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, সাকা চৌধুরী, মীর কাশেম আলী ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ বিভিন্নজনের শাস্তি হয়েছে, রায় কার্যকর করা হয়েছে।

দেশের মেধাবী ও শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিঘেরা শোকাবহ এ দিনে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরে হলেও গোটা জাতি ও শহীদদের স্ত্রী,পুত্র-কন্যা এবং স্বজনরা আনন্দিত। এ জন্য যে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। অপেক্ষমান অনেকেই শাস্তির প্রক্রিয়া চলছে। এসব সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরকার আজ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকায়। জাতি স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কলঙ্কমোচনের সুযোগ পেয়েছে।

বিজয় দিবস ও ৭ মার্চের কথকতা

ড. ইশা মোহাম্মদ

৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পর আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী বিশেষ প্রচার চালাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিছক উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী ছিল না। তার মধ্যে আছে অনেক কিছু। বহুবার বহুজন এসব বিষয়ে বহুকিছু বলেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ঠিকমতো বোঝেনি। যতটুকু তার রাজনৈতিক ফায়দা ততটুকুই তারা করেছে এবং করছে। ৭ মার্চকে তার প্রকৃত অর্থে ও তাৎপর্যে কখনই উপস্থিত করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল রাজনৈতিক মহাকাব্য। এটুকু বললেই কি শেষ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় যত বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন তার সারৎসার ছিল ওই ৭ মার্চের ভাষণ। এটি বিশ্বের সম্পদ হয়েছে সঙ্গত কারণেই। কিন্তু তার অন্ত্মর্নিহিত বার্তা সম্ভবত বাঙালিরা বোঝেনি। সাধারণ মানুষ তো বটেই, সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও বুঝেছিল কি করতে হবে। তারা মুক্তিযুদ্ধের বার্তা পেয়েছিলো। সাধারণ মানুষের সঙ্গেই মিলেমিশে তারা যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কি করেছিল? তারা একটা ভুল করেছিল। ৭ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা না করে ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করেছিল। ভুলটা এখানেই।

১৬ ডিসেম্বরের পরে ওই ভুল সংশোধন করা যেতে পারত। কিন্তু তাদের কখনই মনে হয়নি যে, তারা বড় ভুল করেছে। একটা ভুলের সংশোধন হয়েছে। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। এটা শেখ হাসিনার স্টেটম্যানশিপের কারণেই হয়েছে। হলেও তা পূর্ণমাত্রায় উচ্চারিত হয়নি। গণহত্যা দিবস ঘোষণা করে বসে থাকলে তো হবে না। সারাবিশ্বে ‘গণহত্যা’ হয়। এখন মিয়ানমারে যেমন হচ্ছে। আরও বহুদিন বিশ্বময় গণহত্যার ঘটনা ঘটবে। শেখ হাসিনার উচিত ছিল বিশ্বময় গণহত্যা প্রতিরোধ প্রেষণা তৈরি করার প্রয়াস গ্রহণ করা। তিনি ওই বিষয়টি বেমামুল ‘গুরুত্বহীন’ করেছেন। কাজটা ভালো হয়নি। দেশে দেশে তিনি শান্তির দূত পাঠাতে পারতেন। সাধারণত সাংস্কৃতিক কর্মীদের দিয়ে ‘দল’ তৈরি করে এ জাতীয় শান্ত্মির দূত প্রেরণ করতে হয়। বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্ত্মানিরা যা করেছে, তা অন্য কেউ তো করতে পারে। তার চেয়ে বেশিও করতে পারে। যেমন ভিয়েতনামে যে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল তেমনটা। শেখ হাসিনা তার ভাবমূর্তি যথেষ্ট বাড়াতে পারবেন, যদি বিশ্বময় গণহত্যা বিরোধী শান্তির দূত পাঠাতে পারেন। মিয়ানমারে যে গণহত্যা ও গণনির্যাতন হচ্ছে- সে ব্যাপারে শেখ হাসিনার কথায় অনেকেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। ওআইসি যে প্রস্তাব দিয়েছে জাতিসংঘে তার বিরুদ্ধে ২৬টি দেশ ভোট দিয়েছে। বিশ্বময় শান্তির বাণী প্রচারের কাজ করতে পারলে কেউই বাংলাদেশের আহ্বান ফেরত দিতে পারতো না। ভাবমূর্তির বিশাল গুরুত্ব আছে। দেরি হলেও শেখ হাসিনার উচিত নয়, গণহত্যা দিবসের পরবর্তী কার্যক্রম গুরুত্বহীন মনে করা। ভাষা আন্দোলনের ২১ ফেব্রুয়ারি যেমন বিশ্বময় গৃহীত হয়েছে- তেমনি গণহত্যা দিবসও বিশ্বময় গৃহীত হতে পারে। ৭ মার্চকেও প্রতিষ্ঠিত করা যায়। ৭ মার্চের মধ্যে শোষিত মানুষের মুক্তির কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী তা প্রচার করা যায়। ৭ মার্চ মানুষ ও মানবাত্মার মুক্তির কথা বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী তাও প্রচার করা যায়। সর্বোপরি ৭ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা যায়। ২৬ ও ২৭ তারিখ স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে। কালুরঘাটে মেজর জিয়া যে ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন সেখানে প্রথমে তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন করেছিলেন। তার ভুল সংশোধন করে দিয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক কর্মীরা। জিয়া দ্বিতীয়বার ঘোষণাপত্র পাঠে আর ভুল করেননি। ২৭ মার্চ তদানীন্ত্মন রেডিও পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যখন জিয়াকে অনুরোধ করেছিল, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার জন্য তখন তারা কোনো ড্রাফট তার কাছে দেয়নি। জিয়া নিজে লিখেছিলেন। জিয়া কেন নিজেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন? মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছিল, তারা সবাই জানেন জিয়া ‘মাল খালাস’ করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তার সঙ্গীদের নিয়ে তিনি মাল খালাসেই যাচ্ছিলেন। পথে কেউ একজন তার কানে কানে কি যেন বলেছিল। তিনি সঙ্গীদের বললেন আমরা বিদ্রোহ করেছি। তিনি ‘খালাস’ না করে ক্যান্টনমেন্টে ফিরলেন। তারপর কি করেছিলেন? তারপর যা যা করেছিলেন তার সবই সন্দেহজনক। পরবর্তী সন্দেহজনক কাজকারবার থেকেই অনুমান করা যায় যে, তিনি কুপ্ররোচণায় আপ্লুত হয়েই নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল না। হজপজ লাগানোই তার উদ্দেশ্য ছিল। সে সময়কার সামরিক বাহিনীর লোকজন যারা জীবিত আছে তাদেরকে ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে। দু-একজন গবেষক দিয়ে এ কাজ করা যাবে না। বেশ কয়েকজন গবেষক দিয়ে কাজটা করা হলে প্রকৃত সত্যের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষণাকারী কে- সে সমস্যারও মীমাংসা হয়ে যাবে।

প্রকৃত বিষয় জানা হলেই সব কাজ শেষ হবে না, ৭ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে মূল্য দিতে হবে। ২৬ তারিখটাকে সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা যায়। এভাবে ৭ ও ২৬ এর তাৎপর্যকে চির অম্লান করা যায়। হিসাবটা এরকম। ২৫ তারিখ সশস্ত্র হামলা করেছিল পাকিস্তানি জান্তারা। নিষ্ঠুরতম গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধের প্রয়োজন ছিল। বঙ্গবন্ধু আক্রমণকারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভুক্তভোগী প্রতিরোধকারী। তিনি গণহত্যার প্রতিরোধ করেছিলেন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়। সশস্ত্র যুদ্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার কথাও বলেছিলেন প্রতিরোধ কৌশল হিসেবে। ২৫ তারিখ রাত ১২টা পার হওয়ার জন্য ২৬ তারিখ হিসেবে চিহ্নিত। বাস্তবতাকে হিসাবে নিলে তা ২৫ তারিখই। এ ঘণ্টার এপার ওপার হওয়ার জন্য ২৬ হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এরপর সারা বাংলা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। ২৬ তারিখ হবে সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস। প্রতিরক্ষার লড়াই শুরু হয় এ দিবসের পর থেকেই। ইতিহাসকে ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা করতে নেই। মূল্যায়নও হবে বিজ্ঞানমনষ্ক। মুক্তিযুদ্ধের বিজ্ঞানমনষ্ক মূল্যায়ন হয়নি। এখন সময় হয়েছে প্রকৃত মূল্যায়ন করা এবং যার যা মূল্য তাকে তা দেয়া।

জাতি গঠন প্রক্রিয়া সার্বক্ষণিক। মুহূর্তপত্র বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। সে কারণে নেতৃত্বকে সব সময় সাবধান হতে হয়। পার্টি প্রবল হলে অনেক কিছুই এড়িয়ে যাওয়া যায়। অনেক কিছুকে পাত্তা না দিয়েও কাজ করা যায়। কিন্তু পার্টি দুর্বল হলে সাবধান হতে হয়। শেখ হাসিনা অনেক বড় হয়েছেন। কিন্তু তার পার্টি এখনও বড় হয়নি। তাদের আত্মসংহতি খুবই দুর্বল। সে কারণে নেতৃত্বের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলোকে খুঁচিয়ে ক্ষেপিয়ে দিলে খুব একটা লাভ হবে না। অধিকাংশ সাধারণ মানুষ চাচ্ছে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন হোক। বিশ্বজনও ওই রকমই ভাবছে। সব দলের অংশগ্রহণের জন্য শেখ হাসিনাকে নতি স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অহেতুক খোঁচানোরও দরকার নেই।

বিএনপি নিজের অস্থিত্বের কারণেই নির্বাচন করবে। কিন্তু তাই বলে নির্বাচন না করলে চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে- এমনটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। বিএনপির এজেন্সিগিরি তো বন্ধ হবে না। এজেন্ট হিসেবেই রাজনৈতিক দল। যতদিন তারা এজেন্ট থাকবে ততদিনই তারা বেঁচে থাকবে। শেখ হাসিনার ক্ষমতা নেই তাদেরকে চিরতরে ধ্বংস করা। তাই রাজনৈতিকভাবে তাদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে। নাকে খত দিতে বললে তাদের প্রভুর মান থাকে না। শেখ হাসিনা বিএনপিকে পেটালে তাদের প্রভুদের দেহাঙ্গ বেদনার্ত হয়। প্রয়োজন না থাকলে ক্ষ্যাপানো উচিত নয়।

নির্বাচনের সঙ্গে দিবসগুলো উদযাপনের সম্পর্ক আছে। বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন আমাদের দেশে সামন্ত্মযুগীয় মডেলে উদযাপিত হয়। একজন রাজা যেভাবে উদযাপন করে, অনেকটা সেরকম; কিন্তু একজন স্বার্থক বিপস্নবী রাজার মতো দিবস উদযাপন করে না। বিজয় দিবস উদযাপন মানে হেসেখেলে নেচেকুদে আনন্দফুর্তি করে সময় ব্যয় করা নয়। বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবসে প্রতিজ্ঞার বিস্ফোরণ ঘটাতে হয়। যুদ্ধ যে এখনো শেষ হয়নি। জাতি গঠন প্রক্রিয়া কৈশোরেই আছে। কেন এমন অবৈজ্ঞানিকভাবে বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়। কারণ সম্ভবত একটাই। বঙ্গবন্ধু একটি সার্থক বিপস্নব সম্পন্ন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ তার বিপ্লবের বিষয়টি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি। যে কারণে তার দ্বিতীয় বিপ্লব ‘বাকশাল প্রক্রিয়া’ পার্টির অনেকেই গ্রহণ করেনি। এখনও বহু নেতাই বাকশালের সমালোচনা করেন। যদি তারা মেনে নিতেন বঙ্গবন্ধুর ‘বিপ্লব’ তাহলে অবশ্যই মেনে নিতেন বাকশাল। আর বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবস এমন সামন্ত্মযুগীয় মডেলে উদযাপন করতেন না। নির্বাচন যদি করেন তবে দিবসগুলো উদযাপনে গণসম্পৃক্ততাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। বিপুল অর্থ ব্যয়ের এই উদযাপন কাজে লাগবে। নইলে একান্ত্মই অপচয় হবে। নির্বাচনের আগে আগেই আওয়ামী লীগের চিকিৎসা প্রয়োজন। দিবস উদযাপনের ছলে স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগই শুধু নয়, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগেরও চিকিৎসা হয়ে যাবে। স্থানীয় পর্যায়ের ব্যক্তিগত আওয়ামী লীগারদের চিকিৎসাই হবে না কেবল, শিক্ষাও হয়ে যাবে। একটা উন্নতমানের পরিকল্পনা প্রস্তুত করা উচিত। যে পরিকল্পনামাফিক সবাই দিবসগুলো উদযাপন করতে পারে। সমস্যার তো সীমা নেই। পাহাড়ে ঝামেলা চলছে। এবার জাতীয় বিজয় দিবসে পাহাড়ে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ও সামরিক বাহিনীর খেলাধুলার অনুষ্ঠানও করা যেতে পারে।

শত উস্কানি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। তার অবস্থান থেকে কেউ তাকে সরাতে পারছে না। এটি শুভলক্ষণ। কিন্তু পাহাড়ের ব্যাপারে বিশেষ জাতীয় তৎপরতা প্রয়োজন। নইলে জাতির মনোবল ভেঙে যেতে পারে। নির্বাচনেও ওই মনোবল কাজে লাগবে। সে কারণে মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখার সব চেষ্টাই করতে হবে।

জাতবৈরীরা সব রকম চেষ্টাই করে যাচ্ছে। তারা আরও অভিনব পদ্ধতিতে জাতিকে আক্রমণ করবে। চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। শত বৈরিতার মধ্যেও করতে হবে কাজ। ড. ইশা মোহাম্মদ: প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলাম লেখক। শিক্ষক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়


 

বছর বিজয় দিনে রাজনীতির সাতকাহন

কামাল লোহানী

মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত সশস্ত্র লড়াইয়ের বিজয় এলো এই ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। রক্তে ধোয়া ৯ মাসের প্রবল প্রাণের বিপুল শক্তিতে একদণ্ড উত্থিত পূর্ববাংলার অকুতোভয় মানুষ পাকিস্তানি উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ তেইশ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে শোষণ-শাসনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন সরলপ্রাণ মানুষ- হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। এমনকি উর্দুভাষী প্রগতিমনা, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতাসহ সচেতন জনগণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ আহ্বান সেদিন উপেক্ষা, অবহেলার বিরম্নদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গর্জে উঠতে দেখেছিলাম এবং প্রাণোৎসর্গ করে লড়েছিলাম মুক্ত স্বদেশ অর্জনের আকাঙ্ক্ষায়। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র ছিল মূল লক্ষ্য ও স্স্নোগান। তাজউদ্দিন আহমদের দক্ষ ও প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক দূরদর্শন অভিভাবকত্ব যদি সেদিন না থাকত, তাহলে আমরা কি আজ এই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে বাস করতে পারতাম? যদি না মুক্তিফৌজে সরলপ্রাণ অমিততেজ সাধারণ মানুষ অস্ত্রহাতে তুলে না নিতেন তবে কি আমরা মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বাস করতে পারতাম?

মুক্তিযুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার প্রধান এবং মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক মহান সংগঠক ও সাহসী রাজনীতিবিদ তাজউদ্দিন আহমদ যদি হাল না ধরতেন, তবে কি আমরা বিজয় অর্জন করতে পারতাম? বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্ত্মানি কারাগারে বন্দি, মামলা হচ্ছে, ফাঁসির হুকুম হয়েছে। কিন্তু পাকিস্ত্মানি সেনাবাহিনী নিশ্চিত পরাজয় এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে জীবিত বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্ত্মানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।

 

খন্দকার মুশতাক তো বন্ধু ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের; কিন্তু তার বিনিময়ে মুশতাক যখন মার্কিনি মদদে মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে কনফেডারেশন করার ষড়যন্ত্র করছেন, তখন বলিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধ-মহানায়ক তাজউদ্দিন আহমদ সাহসের সঙ্গে তার মোকাবেলা করেছেন নিজ বুদ্ধিমত্তা আর মুক্তিবাহিনী নিরন্ত্মর বিজয়ের সংবাদে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রাক-প্রস্তুতি পর্বে পূর্ববাংলার প্রগতিশীল বামশক্তি তথা কমিউনিস্ট পার্টিও ছিল এক মজবুত ভিতের ওপর, জনগণ ছিলেন আস্থাবান এবং পার্টি ছিল জনপ্রিয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকালে চীন-রাশিয়া, বিভক্তির প্রভাব পরে রাজনৈতিক যুদ্ধেও। চীনাদের একাংশ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও অন্য অংশ পার্টিগত মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতা অব্যাহত রাখল। আরেকটি কট্টরপন্থি কমিউনিস্টরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই করল। আর রম্নশপন্থি কমিউনিস্টরা নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে একক শক্তিতে পরিণত হলো; কিন্তু তারপরও তাদের অর্থাৎ ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ইউনিয়ন যে গেরিলা কমান্ড গঠন করেছিল তাকে আওয়ামী লীগ বিশেষ করে ছাত্রলীগরা সহ্য করতে পারল না। বিরোধিতা চরমে উঠল। তবুও এই কমিউনিস্ট পার্টি বিজয়ের পর আওয়ামী লীগকেই সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার পরও তারা সমর্থন অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু অবশেষে তাদের বন্ধুত্বের শক্ত গাটছড়া ছিঁড়ে গেল। তবু তো রম্নশপন্থি আওয়ামীদের প্রতি দুর্বলতা অব্যাহত থাকল। আর চীনপন্থিরা সরাসরি আওয়ামী বিরোধিতায় সবাই এক না হলেও বিরোধী ভূমিকাকে আরও জোরদার করল।

আজ এই দু’পক্ষের ভূমিকা কী? রম্নশরা ত্যাগ করলে চীনারা ক্রমেই আওয়ামী লীগের কাছে যেতে চেষ্টা করতে করতে একসময় রম্নশপন্থিদের মতো নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেও দ্বিধা করল না। যেন বামপন্থিদের প্রতিযোগিতা। একসময় তোমরা ছিলে, এবার আমরা না হয় গেলামই। রম্নশিরা অকুণ্ঠ সমর্থন দিলেও নির্বাচন করেছেন তবে ক্ষমতা ভাগের দাবি করেননি। তবে যত দিন বন্ধুত্ব বজায় রেখে সমর্থন দিয়েছে, ততদিনে কমিউনিস্ট পার্টির চরিত্র অনেকটাই স্খলিত হয়ে গিয়েছিল। তারপরও স্বকীয়তা ছিল। কিন্তু একি দেখছি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সাম্যবাদী দল একেবারে ‘মন্ত্রিপ্রবর’ সেজে ক্ষমতা লিপ্সা সাধ পূর্ণ করছেন। বকা খাচ্ছেন, তবু বিরোধিতা করার শক্তি নেই। বর্তমান সরকার ১৪ দলীয় জোটের হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই সরকারের কথা উলেস্নখ করেন তখন তিনি আওয়ামী লীগ সরকারই বলেন সবসময়। ভুল করেও ১৪ দলীয় বা মহাজোট শব্দটাও উচ্চারণ করেন না। তাজ্জব ব্যাপার হলো এর কোনো প্রতিবাদ করার সাহস কারো নেই।

সাম্যবাদী দিলীপ বড়ুয়া ছিলেন খালেদা জিয়ার ‘বিশ্বস্ত্ম চীনাবন্ধু’, কিন্তু মন্ত্রিত্ব অফার করতেই আওয়ামী সরকারে যেতে সংকোচ বা দ্বিধা করলেন না। হাসিনাও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী চীনকে বাগে আনতে বড়ুয়া বাবুকে ব্যবহার করলেন। অথচ ওর চেয়ে সংগঠনগত শক্তিতে মেনন ও ইনু অনেকটা শক্তিশালী ছিলেন। তাদের দিয়ে ১৪ দলীয় নির্বাচন করালেন ‘নৌকা’ নিয়ে এক গুজব ছিল ওরা মন্ত্রী হবেন। কিন্তু ঘটনাটা উল্টো হলো। বড়ুয়া হলেন মেনন-ইনু ‘ফ্যাব’ খাটতে থাকলেন তবে মুলা ঝুলানো রইল। একসময় তারা দু’জনেই মন্ত্রী হলেন। চালাচ্ছেন ভালোই। তবে পরের নির্বাচন শেষে ওদের ভাগ্য কি হবে তা কেবল হাসিনাই জানেন।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন করার সময় প্রথমে ১৪ দল, পরে এরশাদকে নিয়ে মহাজোট গঠন করা হয়েছিল। অনেকের অনীহা সত্ত্বেও হাসিনা এরশাদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। তবে কালক্রমে এরশাদ প্রমাণ করেছেন, তিনি কখনই নির্ভরযোগ্য নন। তবু তার দলীয় সদস্য গুরম্নত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্বে রয়েছেন আর তার স্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রী সংসদে। এমন গৃহপালিত বিরোধী দল কার না ভালো লাগে। এরশাদ সেই ব্যক্তি, যিনি মিছিলে ট্রাক তুলে ছাত্র হত্যা করেছেন। তিনি গণতন্ত্রের দাবি করায় নূর হোসেনকে হত্যাও করেছিলেন। ধর্ম নিরপেক্ষতার দিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তকমা এঁটেছেন সংবিধানে। ভদ্রলোক কখন যে কি বলেন, তার ঠিক নেই। কখনও সরকারের সমালোচনা করেন তবে তার স্ত্রী আবার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। অদ্ভুত নরম গরমের মেশাল তার অস্ত্মিত্ব। স্বামী-স্ত্রীতেও নেতৃত্ব নিয়ে গং বেধে যায়। সত্যিই তো এক অনন্য চরিত্র।

বিএনপি যে ভুল করেছে ২০১৪-এর নির্বাচনে, এ বছর আর করবেন বলে মনে হচ্ছে না। তবে যে সহায়ক সরকারের কথা বলছে তার কোনো অবকাঠামো আজও দেখতে পাইনি। তবে ক্ষমতাসীনরা যাই করম্নক, ভালো আর মন্দ তারই সমালোচনা করে চলেছে। মামলা হামলা, হত্যা, গুম, খুনে জর্জরিত এটাও ঠিক। এ সত্ত্বেও নির্বাচনে এবার যাবে, না হলে রাজনৈতিক দল হিসেবে অস্ত্মিত্বই টিকিয়ে রাখতে পারবে না। কারণ ব্যাক অ্যান্ড ফ্রন্টে সংখ্যাগুরম্নই নির্বাচন করতে চান। ভয় তাদের আওয়ামী লীগের শক্তিকে। নির্বাচন হবে তো! নাকি জবরদস্ত্মি ভয় আর কারসাজি হবে প্রধান অস্ত্র। এসব সত্ত্বেও, ভাই বিএনপি নির্বাচনে যাও। তবে জামায়াতকে সাথে নিয়ে যাবার যে ঘোষণা মওদুদ দিয়েছেন, তা যদি হয় তবে বিপাকে পড়তে হবে। যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত ছেড়ে চলুন, আবশ্য গোপনে তাদের দলে ঢুকিয়ে নিলে কি আর করা যাবে। এটা করবেন না যদি মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেন।

যা হোক, এবার শুনলাম বিকল্পধারা জাসদ (রব) নাগরিক ঐক্য এরা ইতোমধ্যে এক অঘোষিত বৈঠক করেছেন তাতে কাদের সিদ্দিকীও বোধহয় ছিলেন। ড. কামাল থাকবেন কি-না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে মাহমুদুর রহমান মান্না তো আছেন, দেখলাম মাহী বি চৌধুরীর আবির্ভাব হয়েছে ইদানীং টেলিভিশনের টকশোর বদৌলতে। যাকগে সেসব কথা, ওরা নাকি যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছেন। শুনে হাসিও পেল। ০+০=০ এই তো হয়। কিন্তু উনারা ১৯৫৪-য় যুক্তফ্রন্টকে সামনে রেখে নাকি নামকরণ করেছিলেন। সেটার নেতৃত্বে ছিলেন শেরেবাংলা শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর মওলানা ভাসানী। ওজনটা বুঝতে পেরেছেন? সেই হিসেবে নিজেদের ওজন বোঝার চেষ্টা করুন। তবেই বুঝবেন কত ধানে কত চাল। রাজনীতিটাকে হাস্যকর বালখিল্য করবেন না। দোহাই আপনাদের। বিজয়ের এই দিনে এসবের সমিকরণেই করতে হবে আমাদের অর্থাৎ জনগণকে।

মুক্তিযুদ্ধ : বাঙালি জাতিসত্তার জয়

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

১৯৪৭’র পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আমাদের জন্যে একটি প্রতারণা, একটি নতুন কলোনিতে পরিণত হওয়া ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। সেটা বুঝতে বাঙালির মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হয়নি। তাই ১৯৪৮’র ভাষাআন্দোলনের সূচনার মাধ্যমে বাঙালি জাতি-চেতনা অংকুরিত হয়ে মহীরুহ হবার পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৫২-তে জীবন দিয়ে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করার মধ্যেই আমরা অর্জন করি প্রথম সাফল্য।

আমরা যদি এই পূর্ববাংলার ভূখণ্ডের কথা চিন্তা করি তাহলে প্রথম থেকেই দেখতে পাবো, কেউই আমাদের উপর শাসন চাপিয়ে স্থায়ী হতে পারেনি। সারা ভারতে আর্য শাসন স্থায়ীভাবে অধিকার বিস্তার করলেও পূর্ববঙ্গের স্বাধীনচেতা মানুষের কাছে বার বার প্রতিহত হয়েছে। নদী ভাঙন, বৈরী আবহাওয়া, জলমগ্নতা এই সমস্ত কিছুর সঙ্গেই লড়তে লড়তে আমাদের পূর্বপুরুষেরা হয়ে ওঠেন সংগ্রামশীল। সে সময় আর্যপীড়কদের বিরুদ্ধে যে কৌশলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা লড়াই করেছেন, ১৯৭১ সালে আমরা তারই পুনরাবৃত্তি দেখেছি। আঘাত কর— সরে যাও— মিশে যাও— নিজের চেনা মানুষের ভিড়ে। ৭১-এর গেরিলা যুদ্ধের বীজ যেন লুকানো ছিলো শতাব্দী ধরে আমাদের রক্তের ধারাবাহিকতায়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করতে না দেয়ায় বিপ্লবী ঢাকা বেতারের কর্মীরা বেতার বন্ধ করেছেন, ৮ই মার্চ সেই ভাষণ যা ধারণ করেছিলেন নাসার আহমেদ চৌধুরী নামে এক তদানীন্তন অনুষ্ঠান সংগঠক, তা প্রচার করতে দেবার শর্তে আবার বেতার কেন্দ্র খোলা হয়। প্রচারিত হয় সেই মহাকাব্যিক ভাষণ। সারা দেশের লোক সেটা শুনতে পান। জেগে ওঠেন সংগ্রামী চেতনায়। সারা দেশের মানুষ সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশনা দেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন শুরু করে। তাদের মধ্যে ঐ ভাষণে যে সংগ্রামী চেতনার জন্ম হয় তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি নিজে। ১৯৭১-এর ১৭ই মার্চ পরিবার নিয়ে রাজশাহী থেকে সিলেট রওয়ানা হই ট্রেনে। সিরাজগঞ্জ ঘাটে মালপত্রসহ স্টিমারে ওঠার পর জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে আবার স্টিমার থেকে ট্রেনে মালপত্র তোলার মতো টাকা আমার কাছে ছিল না। কিন্তু ঘাটের কুলিরা সব মালপত্র তুলে দিয়ে বলে ‘দেশ স্বাধীন না হইলে টেকা পয়সা দিয়া কী করব। দেশ স্বাধীন হউক তখন আইসা মিষ্টি খাওয়ায় যাইয়েন’। আমি বুঝতে পারি ভাষণটি বেতারে প্রচার হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্র কণ্ঠ সাধারণ মানুষকেও কতটা উজ্জীবিত করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে গেছে তারা। ৯ মাসব্যাপী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে তাদেরও কতজন আছেন কে জানে। ৫২-৭১ পর্যন্ত প্রতিটি গণআন্দোলনে প্রাণ দিতে হয়েছে এদেশের মানুষকে। চূড়ান্ত আত্মত্যাগের মাধ্যমে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি আমরা। কিছু সুবিধাভোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তাদের পরিচালনাকারী দেশদ্রোহীরা ছাড়া বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে সাধারণ জনগোষ্ঠীর এই লড়াই পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্বিতীয়। যেমন অদ্বিতীয় বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ- আজ সেই ভাষণের বিশ্ব স্বীকৃতি আমাদের গৌরবকে করে তুলেছে আকাশচুম্বি।