বাবুলের মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী : স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা

স্টাফ রিপোর্টার: পুলিশের হামলায় দগ্ধ চা বিক্রেতা বাবুল মাতুব্বরকে বৃহস্পতিবার গভীর রাতেই চোখের জলে চিরবিদায় জানানো হয়েছে। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। আর এ মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসনিক কারণে শাহ আলী থানার ওসি একেএম শাহীন মণ্ডলকেও প্রত্যাহার (ক্লোজ) করা হয়েছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার শাহ আলী থানার এসআই মোমিনুর রহমান খান, নিয়াজ উদ্দিন মোল্লা, শ্রীধাম চন্দ্র হাওলাদার এবং এএসআই দেবেন্দ্র নাথ ও কনস্টেবল জসিম উদ্দিনকে প্রথম ক্লোজ ও পরে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনায় আটক পারুল বেগমকে ২ দিনের রিমান্ডে (জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজত) নিয়েছে পুলিশ।
বাবুলের স্ত্রী লাকি ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আর মেয়ে লাবনী এবারের এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু বাবার মৃত্যুতে আজ সব এলোমেলো হয়ে গেলো। বুক ফাটা আর্তনাদ নিয়ে লাকি বলেন, ‘আমি এখন ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোথায় যাবো। ছোট মেয়ে লাবনী এসএসসি পরীক্ষার্থী। ও কীভাবে পরীক্ষা দেবে। ৪ বছরের ছেলে জোনায়েদকে কীভাবে মানুষ করবো? আমাদেরকে ওরা পথে বসিয়ে দিল।’ তিনি বলেন, এর আগেও সোর্স খুনের ঘটনায় আমার বড় ছেলেকে গ্রেফতার করলেও আমরা গরিব বলে থানা পুলিশসহ কেউ আমাদের কথা শোনেনি। সত্যের জয় হয়, আমার ছেলে জামিন পেয়েছে। আমার স্বামীকে যারা পুড়িয়ে মারলো আমি আপনাদের কাছে তাদের বিচার চাই।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমশিনার (মিডিয়া) মারুফ হোসেন সরদার বাংলামেইলকে বলেন, ‘নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে ও প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে তিন এসআইসহ ৫ পুলিশ সদস্যকে বৃহস্পতিবার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার বিকেলে প্রশাসনিক স্বার্থে শাহ আলী থানার ওসি একেএম শাহীন মণ্ডলকে ডিএমপি সদর দফতরের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ অফিসে ক্লোজ করে সংযুক্ত করা হয়েছে।’ এদিকে ক্লোজ হওয়ার আগে শাহ আলী থানার ওসি একেএম শাহীন মণ্ডল জানিয়েছিলেন, চা দোকানি মৃত্যুর ঘটনায় এজাহার নামীয় আসামি পারুল বেগমকে আদালাতে পাঠিয়ে সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত দু দিনের রিমান্ড অনুমোদন করেন। পারুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মূল ঘটনা ও পলাতকদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে বলে তিন আশা করছেন। ৫ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সঠিকভাবেই তদন্ত করা হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার নিহত বাবুলের বড় ছেলে রাজু কাঁদদে কাঁদতে ওসির কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন, স্যার পুলিশ আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। পুলিশের পোশাকে তো নাম লিখা থাকে তাহলে আপনারা তাদের বিরুদ্ধে কেন মামলা করেননি? এমন প্রশ্নে ওসি বলেন, ঘটনার সময় হুলুস্তুলের মধ্যে পুলিশের নাম খেয়াল করতে পারিনি।
এ সময় রাজুর খালা শামসুন্নাহার বুচি বলেন, তড়িঘড়ি করে পুলিশ মামলা করতে চাপ দেয়ায় আমার ভাগ্নি (বাবুলের মেয়ে) মামলা করেছে। তখনো আমরা বলেছি পুলিশ এ ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু পুলিশ আমাদের কথা শোনেনি। পরে আমরা জেনেছি এসআই মোমিনুল ও এএসআই দেবেন্দ্র নাথসহ ৪/৫ জন পুলিশ এ ঘটনায় ঘটিয়েছে। পরে থানার ওসি, ডিসি ও এডিসি স্যাররা আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন যে, পুলিশের কেউ যদি এ ঘটনায় জড়িত থাকে, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া হবে। থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি। তিনি আরো বলেন, ওই সময় দায়িত্বে থাকা এবং এ ঘটনায় জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে আমরা সিএমএম আদালতে মামলা করবো। থানার কয়েকজন পুলিশ মদ-গাঁজা খায় বলে পারুলের সাথে তাদের খাতিরও বেশি। পারুলের কথা শোনে তারা আমার বোনের স্বামীকে মেরে ফেলেছে। বাবুলের বড় ছেলে রাজু আরো বলেন, গতবছর ১৫ আগস্ট রাতে পারুলসহ অন্যদের মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সোর্স খুন হয়। ওই সময়ও আমাকে ওই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়। আমি ভাএলা বলে এলাকার অনেকেই সাক্ষি দেয়ায় আমি জামিন পাই। কিন্তু ওরা আমার বাবাকে খুন করে আমাদেরকে পথে বসিয়ে দিল। দোলায়রসহ ওই পুলিশ সদস্যরা মারধর করে আমার বাবার গায়ে চুলা ছুড়ে মারাতে তিনি দগ্ধ হন। ওরা আমার দগ্ধ বাবাকে হাসপাতালে নিতেও সাহায্য করেনি। আমরা এর বিচার চাই। এ ঘটনার পর শাহ আলী এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। নিন্দার ঝড় উঠেছে সারাদেশের মতো গুদারাঘাট এলাকায়ও। গত বৃহস্পতিবার রাস্তায় আগুন ধরিয়ে ও অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয়রা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বুধবার থেকেই এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী মোটরচালক লীগের এক আলোচনা সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল খান জানান, এ ঘটনায় দোষী পুলিশ সদস্যদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। তবে শুধুমাত্র দু-একজন পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অপকর্মের কারণে পুরো পুলিশ বিভাগকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।
প্রসঙ্গত, বুধবার মিরপুর ১ নম্বর গুদারাঘাটে চাঁদা না পেয়ে পুলিশ চা বিক্রেতা বাবুলের চায়ের দোকানের কেরোসিনের চুলায় বাড়ি মারলে কেরোসিন ছিটকে তার গায়ে আগুন ধরে যায়। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাবুল মাতব্বর মৃত্যুবরণ করেন।