বাংলাদেশে দু মেয়ের বিয়ে?

স্টাফ রিপর্টার: বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি গ্রাম থেকে আসা একজন নারী সানজিদা। ভালবেসেছেন তারই মতো একজন নারীকে। আর সে কারণেই তাকে পড়তে হয়েছে নানা হয়রানিতে। জেলও খাটতে হয়েছে। সেই ভালবাসার গল্প বিবিসিকে অকপটে বলেছেন সানজিদা। ২০১৩ সালের কথা। সানজিদার বয়স তখন ২০ বছর। পড়ালেখার জন্য ঘর ছাড়ার পর এমন একজনের সাথে তার দেখা হলো যাকে নিয়ে জীবনের বাকিটা কাটাতে চাইলেন তিনি।
কিন্তু সমস্যা হলো সেই ব্যক্তিও একজন নারী। কিন্তু বাংলাদেশে সম লিঙ্গের বিয়ে গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে নিজের সুখের বদলে তাকে পড়তে হয়েছে অপহরণের অভিযোগের মুখে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় পিরোজপুর শহরের একটি গ্রাম থেকে লেখাপড়ার উদ্দেশে সানজিদা চলে আসেন জেলা শহরে। পরিবারের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী সন্তানটি সংসারের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন-এই আশায় তার স্কুল শিক্ষক বাবা তাকে বাড়ি থেকে দূরে পাঠাতে রাজি হন। পিরোজপুরে বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা শুরু হয় সানজিদার। সেখানে হিন্দু ধর্মানুসারী একজন ব্যবসায়ী কৃষ্ণকান্তের অনুরোধে তার মেয়ে পূজাকে পড়াতে শুরু করেন সানজিদা। এরপর ১৬ বছর বয়সী পূজার সাথে সম্পর্ক তৈরি হয় সানজিদার। সানজিদার জিনস আর টি-শার্ট গতানুগতিক গ্রাম্য সমাজে কিছুটা দৃষ্টিকটু বলে বিবেচিত হলেও, কৃষ্ণকান্তর পরিবার তাকে বেশ পছন্দই করতো।
কিন্তু এই সমাজে দুটো মেয়ের প্রেম কেউ মেনে নেবে না সেটা ভালোই জানতেন সানজিদা এবং পূজা। ফলে তারা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৩ সালেরই জুলাই মাসে পিরোজপুরেরই ১৭শ শতকের একটি মন্দিরে গিয়ে মালা বিনিময়ের মাধ্যমে তারা বিয়ে করেন। হিন্দু বিয়ের রীতি অনুসারে পূজার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেন সানজিদা। এরপর তারা লঞ্চে করে বরিশালে চলে যান। সেখানে বাসা ভাড়া নেন।
সানজিদার ভাষায়, সেখানেই আমাদের বিবাহিত জীবন শুরু করি। আমরা সেখানে দেড় সপ্তাহের মতো সময় ছিলো আমাদের একসাথে কাটানো সবচেয়ে সুখের সময়। এমনকি তারা যে বাসায় থাকতেন সেই বাসার মালিকও তাদের দুটি মেয়ের এই প্রেমের সম্পর্কে অভিভূত হয়ে তাদের আশ্রয় দেন বলে জানান। তবে পূজার বাবা কৃষ্ণকান্ত থানায় গিয়ে সানজিদার বিরুদ্ধে তার মেয়েকে অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন। পূজার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পুরো বিষয়টি সাজানো। পূজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে দাবি তার বাবা ও বোনের। পূজার বোন শিপ্রা বলছেন, তার বোনকে চায়ের সাথে এমন কিছু মিশিয়ে দেয়া হয়েছিলো যার ফলে সে চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলো। এদিকে বরিশাল শহর ছেড়ে সানজিদা এবং পূজা চলে যান ঢাকায়। এভাবে পিরোজপুর ছাড়ার পর ৩ মাস কেটে যায়। এমনই এক সময় পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাব তাদের খুঁজে বের করে। সানজিদাকে গ্রেফতার করে পিরোজপুর পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। আর পূজাকে তুলে দেয়া হয় তার পরিবারের কাছে। এরপর সানজিদাকে পড়াতে হয় বিদ্রূপের মুখে। তাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, তোমাকে দেখতে তো খুব নিষ্পাপ মনে হয়। তোমার মনটা এত কুৎসিত কেন?
বাংলাদেশে সমকামীদের একটি সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির পরিচালক ফরিদা বেগম বলছিলেন, এটা শুধু দুই নারীর প্রেমের ঘটনাই নয়, একইসাথে এখানে হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের প্রেমের বিষয়ও রয়েছে। ফলে বিষয়টি কিভাবে সামলাতে হবে সেটি পুলিশ এমনকি সানজিদার আইনজীবীও বুঝে উঠেতে পারছিলেন না। এদিকে গ্রেফতারের পর আড়াই মাস কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পান সানজিদা। জেলের ভেতর নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়তে হয় বলে জানান তিনি। তবে সবচেয়ে কষ্টকর ছিলো তার লিঙ্গ পরীক্ষার বিষয়টি, জানান সানজিদা। তিনি বলেন, নারী পুলিশ সদস্যদের পাঠানো হতো আমি ছেলে না মেয়ে সেটি দেখতে। সে এসে আমার সারা শরীরে হাত দিয়ে দেখতে থাকে। এটি ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক পরিস্থিতি। এতটাই নির্মম ছিলো যে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করতো। তারা ৩ বার একই কাজ করে। তবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিষয়টিকে দুর্ধর্ষ এবং রোমাঞ্চকর প্রেমের গল্প হিসেবে তুলে ধরে প্রচার করে। সাংবাদিকদের পূজা একটি বিবৃতি দেন। সেখানে বলা হয়, একটি ছেলে যদি একটি মেয়েকে ভালবাসতে পারে। তাহলে একটি মেয়ে আরেকটি মেয়েকে ভালবাসতে পারবে না কেন? তবে পূজার পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য দেয়র কথা নাকচ করেছে তার পরিবার।
তার মা পান চিবুতে চিবুতে জানান, ছোটবেলায় সানজিদার ওপর জ্বিনের আছর ছিলো। এরপর তাকে তাবিজ দেন একজন হুজুর। তার একজন ভাই এর প্রশ্ন, সে বলছে যে সে একটি মেয়েকে ভালবাসে। কিন্তু দুটো মেয়ে বিছানায় কি করতে পারে? সানজিদা জানান, পূজার সাথে যোগাযোগের বহু চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সানজিদা এটা হরমনজনিত কোনো সমস্যা বলে মানতে নারাজ। তার দাবি তিনি প্রকৃতিগত ভাবে একজন নারী এবং একজন নারী হিসেবেই তিনি আরেকজন নারীকে ভালবাসেন। সানজিদা নানা হয়রানি ও সামাজিক হেনস্থার পরও মনে করেন, একজন নারীকে ভালবাসার অধিকার তার রয়েছে। সে কারণেই সম্ভবত তিনি আবারও প্রেমে পড়েছেন এবং তার ভালবাসার মানুষটি এবারও একজন নারীই।