বাংলাদেশে গাড়ল চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে

 

 

মহাসিন আলী:দেশে গাড়ল চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ বেশি হওয়ায় এর মাংসের চাহিদা ব্যাপক। অতিরিক্ত মাংস ও দাম বেশি হওয়ায় মেহেরপুর জেলায় গাড়ল পালন দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাড়ল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলার মানুষ। গাড়ল চাষে খরচ কম ও লাভ বেশি হওয়ায় মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে গাণিতিক হারে এর চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। মুজিবনগর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ও মেহেরপুর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার দেশে গাড়ল চাষে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন বলে জানালেন।

মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার তারানগর গ্রামের মিস্ত্রিপাড়ার দবিরউদ্দিন গাড়ল পালনে সফলতা পাওয়ার পর একই গ্রামের অনেকে গাড়ল পালনে ঝুঁকে পড়েন। বর্তমানে ওই গ্রামের প্রায় ২০ ঘর মানুষ গাড়ল চাষ করছেন। এছাড়া মুজিবনগর উপজেলা ছেড়ে এর চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে জেলার বিভিন্ন গ্রামে। বর্তমানে পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন গ্রামে গাড়ল চাষ হচ্ছে।

বর্তমানে তারানগর গ্রামের কালু মণ্ডলের ছেলে শরিফ, আনছার আলীর ছেলে পশু চিকিৎসক রফিক, মৃত খাজেল কিসনির ছেলে রবি, করিম বক্সের ছেলে আব্দুল মজিদ, জাফর শেখের ছেলে মণ্ডল শেখসহ প্রায় ২০ ঘর মানুষ গাড়ল চাষ করছে। তাদের প্রত্যেকের গাড়লপালে ৩০ থেকে ৬০টি করে গাড়ল রয়েছে। তারা প্রত্যেকে জানান, তারানগর গ্রামের মিস্ত্রিপাড়ার দবিরউদ্দিন গাড়ল পালনে সফলতা পাওয়ার পর তারা গাড়ল পালনে ঝুঁকে পড়েছেন। তারা বললেন, বর্তমানে গাড়লের বাচ্চার চাহিদা প্রচুর। খরচ কম ও লাভ বেশি, তাই তারা এচাষ সম্প্রসারিত করবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুজিবনগর উপজেলর জয়পুর গ্রামের ফজু বেড়ে, আনন্দবাস গ্রামের দরুদ কারিকর, মোশা হাউই, কুদ্দুস কাল্টা সদর উপজেলার বারাদী গ্রামের জিনারুল, চুয়াডাঙ্গা জেলার জাহাজপোতা গ্রামের আবুল বিশ্বাস, দর্শনার গোলাম রহমান, চারুলিয়া গ্রামের আলীবুদ্দিন, টেংরা ও শরিফুল ডাক্তারসহ মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের শতাধিক বাড়িতে গাড়ল পালন চলছে। তারা বললেন, গাড়লের বাচ্চা কেনার জন্য ইতোমধ্যে অনেকে অগ্রিম টাকা গাড়লচাষিদের বাড়িতে দিয়ে গেছে।

এলাকার প্রথম গাড়লচাষি তারানগর গ্রামের মিস্ত্রিপাড়ার দবিরউদ্দিন আরো জানালেন, ইতোমধ্যে কুষ্টিয়া ও ঢাকা জেলার ক্রেতা তার নিকট থেকে গাড়ল কিনেছেন। তাদের নাম জানাতে না পারলেও তিনি জানান তারা চাষ করার জন্যই গাড়ল কিনেছেন।এলাকার গাড়ল চাষিরা জানান, গাড়ল মাঠে চরে খায়। বাড়িতে এদের জন্য তেমন খাদ্য দিতে হয়না। প্রতিটি পূর্ণ বয়সের গাড়ল থেকে ৪৫-৬০ কেজি মাংস পাওয়া যায়। যা একটি পূর্ণবয়সী ভেড়ার মাংসের প্রায় ৩ গুণ। মেহেরপুরের মুজিবনগর বাজারে প্রতি কেজি গাড়লের মাংসের মূল্য ৪০০ থেকে ৪২৫ টাকা। যাখাসির মাংসের মূল্যের চেয়েও বেশি। ভেড়ার চেয়ে এর চামড়া বড় ও মূল্য বেশি। দেড় থেকে দু’বছরের পূর্ণ বয়সী একটি গাড়ল ২০-২২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আর মাত্র ৩ মাস বয়সী একেকটি গাড়লের বাচ্চা ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মুজিবনগর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) নূর আলম জানান, উপজেলার তারানগরের মিস্ত্রিপাড়ার দবিরউদ্দিন গাড়ল পালনে সফলতা পাওয়ার পর মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অনেকে গাড়ল পালনে ঝুঁকে পড়েন। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ছে পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। বর্তমানে মুজিবনগর উপজেলায় ছোট-বড় ৬০ থেকে ৭০টি গাড়লের খামার গড়ে উঠেছে। তিনি আরো বলেন, গাড়লের রোগ-বালাই কম। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। গাড়ল চাষ শুরুর পর থেকে এপর্যন্ত গত ৮-১০ বছরে কোনো গাড়ল মারা গেছে এমন রেকর্ড তাদের কাছে নেই। ইতোমধ্যে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের আয়োজনে এলাকার নির্বাচিত ২৫ জন গাড়লচাষিকে ৫দিনব্যাপি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এলাকাসহ দেশে গাড়লচাষের সম্ভাবনার কথা প্রাণিসম্পদ বিভাগের ডিজি মহোদয়কে অবগত করানো হয়েছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শশাঙ্ক কুমার মণ্ডল বলেন, গাড়লের মাংস সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিশ বঙ্গের সাথে এদেশের আবহাওয়ার যথেষ্ট মিল আছে। তাই আমাদের দেশে গাড়লচাষ হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে গাড়ল বছরে ২ বার বাচ্চা দিলেও ২টি থেকে ৪টির বেশি নয়। তাই দেশি ভেড়ার সাথে গাড়লের সংকর করতে পারলে হয়তো বাচ্চা বেশি পাওয়া সম্ভব। তিনি আরো বলেন, দেশি ভেড়ার সাথে গাড়লের কমপক্ষে ৩ বারের সংকর জাত বেশি টেকসই হবে ও বাচ্চা বেশি দেবে।পালে নতুন নতুন মেড়া (পুরুষ গাড়ল) রাখার কথাও বলেন তিনি। কোনো মেড়া ২ বছরের বেশি পালে না রাখার পরামর্শও দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের তারানগর গ্রামের মিস্ত্রিপাড়ার দবিরউদ্দিন ২০০২ সালে ভারত থেকে ৩টি গাড়ল কিনে চাষ শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি সফলতার মুখ দেখেন। লাভ দিয়ে সংসার খরচ করার পাশাপাশি তিনি ২টি মাইক্রোবাস কিনেছেন ও ৩ বিঘা জমি কিনে ওই জমির ওপর পুকুর কেটেছেন। চলতি বছরে তিনি আরো দেড় বিঘা মাঠের জমি কিনেছেন। তার সফলতা দেখে আশেপাশের এলাকার অনেকে গাড়লচাষ শুরু করেন। তারাও লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন।