বনানীতে ভয়ঙ্কর গ্যাস বিস্ফোরণ : বিশাল ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা

 

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর বনানী অভিজাত এলাকার একটি বাড়িতে গ্যাস পাইপ লাইনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ছয়তলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল ভবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আহত হয়েছেন বাসিন্দাদের বেশ কয়েকজন। বাড়ির বাসিন্দা ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, রাস্তায় ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির কাজের সময় গ্যাস পাইপলাইন ফুটো হয়ে যায়। বারবার অভিযোগ দেয়া সত্ত্বেও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ওই লিকেজ বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গ্যাস লাইনের ওই ফুটো থেকেই বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিতাসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী শিবেন্দ্র নাথ ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, ওই ভবনের পাশে গ্যাসের পাইপলাইনে ছিদ্র পাওয়া গেছে। ভবনের নিচ দিয়ে ২ ইঞ্চি পাইপ গেছে। তাতে পৌনে এক ইঞ্চি ছিদ্র করে সেখানে পাইপ বসিয়ে বাসায় গ্যাস সংযোগ নেয়া হয়। মূল লাইনে ছিদ্র দিয়ে অনবরত গ্যাস বেরুচ্ছিল। ওই গ্যাস কোনোভাবে পানি বা স্যুয়ারেজ পাইপে প্রবেশ করে। প্রচুর গ্যাস পাইপে ঢুকে পড়ায় বিস্ফোরণ হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক মাসুদুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এক সপ্তার মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। রাজউক ও বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। উত্তরার একটি বাসায় গ্যাস লাইন লিকেজের কারণে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুর রেশ না কাটতেই বনানীতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটলো।

গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ২টার দিকে বনানীর ২৩ নম্বর সড়কের ৯ নম্বরে অবস্থিত ভবনের চারতলায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের শব্দে ওই ভবন ও আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের ঘুম ভেঙে যায়। ভবনের বাসিন্দারা ভয়ে ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন। ঘটনাস্থলে আসে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট। তারা দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলে। বিস্ফোরণে ভবনের দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার সামনের দেয়াল ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়া ইট ও জানালার লোহার গ্রিল ও গ্লাসের টুকরা রাস্তায় গিয়ে পড়ে। গভীর রাতে পথচারী না থাকায় কেউ হতাহত হয়নি। ওই ভবনের সামনের দিকের ৯২ ও ৯৪ নম্বর ভবনেরও জানালার কাঁচ ভেঙে গেছে। এছাড়া দুই পাশের দুই ভবনের জানালার কাঁচ, দরজা ভেঙে গেছে। এ ঘটনায় সাতজন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে বাড়ির মালিক শামসুল আলমের ছেলে নাভেদ ইমতিয়াজ রয়েছেন। আগুনে তার শরীর দগ্ধ হয়েছে। বাকিরা তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে আহত হন বলে বনানী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) নাজমুল হোসেন জানান।

ছয়তলা ভবনটির প্রতিটি তলায় চারটি করে ফ্ল্যাট রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় একটি বায়িং হাউজের অফিস ছাড়া সব ইউনিটই আবাসিক। নিচতলায় রয়েছে গ্যারেজ। রাতেই ঘটনাস্থলে যান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। তিনি ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কাজ তদারক করেন এবং পাশের ভবনের ছাদ থেকে হ্যান্ডমাইকে কথা বলে ছাদে আটকা পড়া বাসিন্দাদের সাহস দেয়ার চেষ্টা করেন। ভবনের আগুন নেভার পর তিনি ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সাথে ওই ভবনের ভেতরে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতি প্রত্যক্ষ করেন। আনিসুল হক বলেন, অগ্নিকাণ্ডের জন্য তিতাস কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দায়ী। সিটি করপোরেশনের খোঁড়াখুঁড়ির কারণে গ্যাসের লাইন লিকেজ হয়নি। গ্যাসের লাইন লিকেজের বিষয়ে আমাদের লোক বেশ কিছুদিন আগে তিতাসে অভিযোগ করেছে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তিতাস, ওয়াসা, ডেসা ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

ভবনের মালিক শামসুল আলম বলেন, গত তিনদিন ধরে গ্যাসের লাইন ফুটো হয়ে গ্যাস বের হচ্ছে বলে আমরা তিতাসে অভিযোগ করেছিলাম। বৃহস্পতিবার তিনবার তিতাসে অভিযোগ করেছি। সকালে একবার, বিকাল ৪টায় ও রাত ১০-৫২ মিনিটে তিতাস গ্যাসে অভিযোগ করা হয়। সর্বশেষ রাত ১০-৫২ মিনিটে সেখানকার অভিযোগকেন্দ্র থেকে একজন বলেন, শ্রমিক পাঠাতে পারলে তারা লাইন মেরামত করে দেবেন। এরপর রাতেই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বাসার মালিক ও বসিন্দারা তিতাস গ্যাসের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করবেন বলে জানান।

ভবনটিতে বাসিন্দাদের বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়নি। দুপুরে প্রতিটি ফ্ল্যাটের একজন করে বাসায় ঢুকতে দেয়া হয় তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর রাজউকের অফিসার মো. আদিলুজ্জামান বলেন, এতে কোনো কাঠামোগত ত্রুটি দেখা দিয়েছে তা আমি বলতে পারবো না। তবে এই ভবনে বসবাস করতে হলে অনেক কাজ করতে হবে। সামনের দিকের ফ্ল্যাটগুলো খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যগুলোর তেমন ক্ষতি না হলেও কোনোটির দরজা ও জানালার গ্লাস অক্ষত নেই।

তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপারেশন) এইচএম আলী আশরাফ বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা মনে করছি ভবনটি সংলগ্ন স্যুয়ারেজের পাইপ দিয়ে গ্যাস ওপরে উঠে গেছে। তিনি অভিযোগ করেন, গ্যাসের লাইন ফুটো হওয়ার কথা ওয়াসা তাদের জানায়নি, জানালে ব্যবস্থা নেয়া যেতো। তিনি বলেন, তিতাস গ্যাসের অভিযোগকেন্দ্র থেকে যিনি শ্রমিক পাঠানোর কথা বলেছিলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, তারা রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি করে পাইপ বসানোর কাজ করছিলেন না। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ও বসবাসের জন্য সাময়িকভাবে অযোগ্য ঘোষণা করেছে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল।

গতকাল বিকালে অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদের নেতৃত্বে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ভবনটি পরিদর্শন করে। রাজউকের চেয়ারম্যান জিএম জয়নুল আবেদীনও সাথে ছিলেন। পরিদর্শন শেষে অধ্যাপক ইশতিয়াক সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। সার্ভে করে দেখতে হবে ভবনটি ভাঙতে হবে কি-না, নাকি সংস্কার করা যাবে। তবে আপাতত ভবনটি বসবাসের অযোগ্য। রাজউক চেয়ারম্যান জিএম জয়নুল আবেদীন বলেন, দেখতে হবে, ভবনটি সংস্কার করলেই চলবে কি-না।