প্রধানমন্ত্রীর দেয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার: জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের ‘অতিরঞ্জিত প্রচার’ চালিয়ে জনগণকে বোকা বানাতে চেয়েছেন বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ গেছে কি-না জানি না। তবে অর্থনীতির লুটপাটের মহাসড়কে যে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান।
সরকারের দুই বছরে পূর্তিতে গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভাষণের প্রতিক্রিয়া জানাতে গতকাল বুধবার গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের রাজনৈতিক দিক নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান। অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেন মঈন খান।
টানা দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার দুই বছর পূর্তিতে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তার সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করতে দলমত নির্বিশেষে সবার সহযোগিতাও চান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
প্রধানমন্ত্রী ভাষণে যা বলেছেন, বাস্তবতা তার চেয়ে ভিন্ন দাবি করে কিছু কাল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মঈন খান সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বলেন, অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক দিয়ে আমি আমার বক্তব্যকে সমর্থন করবে। কোনো গাল-গল্পের ভিত্তিতে নয়। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বিএনপির শাসনামলের সাথে তুলনা করে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং বিভিন্ন অর্জন তুলে ধরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নেয়ার পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলেন।
মঈন খান বলেন, বিএনপি সরকারের শেষ অর্থবছরে আমরা প্রবৃদ্ধি নিয়ে গিয়েছিলাম ৬ দশমিক ৭ শতাংশে। দীর্ঘ ৭ বছর চেষ্টা করেও সরকার (আওয়ামী লীগ) কিন্তু সেই ৬ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছুতে পারেনি। তো উন্নয়নের মহাসড়ক কোন দিকে যাচ্ছে, সেই সূচকগুলো তা বলে দিচ্ছে। আমাদের বলার প্রয়োজন নেই।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিভিন্ন তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে ধরা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, সম্ভবত গতকালের (প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের) স্ক্রিপ্টরাইটার যারা ছিলেন, তারা ভুলে গিয়েছিলেন যে ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান বছর পর্যন্ত বর্তমান সরকার ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে যে অর্থনীতির সূচকগুলো বলেছিল, তার প্রত্যেকটি বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক কনটেস্ট করেছিলো। প্রতিবছরে তাদের যে হিসেব, তা সরকারি হিসেবের অনেক নিচে ছিলো এবং এমন অভিযোগও এসেছে, সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগ তা বাড়িয়ে তৈরি করে। আমরা এটাও দেখেছি, রাতারাতি সেইসব সূচক পরিবর্তন করা হয়েছে। তারপরও সরকার এতো বাড়িয়ে, এতো সাজিয়ে, এতো অঙ্ক কষেও কিন্তু আমাদের শাসনামলের ৬ দশমিত ৭ শতাংশে পৌঁছুতে পারেনি। আমার বিশ্বাস আজকের অর্থনীতি কোথায় আছে এই একটি সূচকই যথেষ্ট, বলেন তিনি।
মঈন খান বলেন, এসব অতিরঞ্জিত (inflated) সূচক দিয়ে দেশের আপামর জনসাধারণকে বোকা বানানো যাবে না। অর্থনীতির যারা বিশেষজ্ঞ, তাদের তো নয়ই।
উন্নয়নের প্রসাধন: মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারসহ অবকাঠামো উন্নয়নের যে চিত্র প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেছিলেন, তাকে প্রসাধনের লেপন বলে আখ্যায়িত করেছেন মঈন খান। সোজা বাংলায় বলতে গেলে, এই সরকার ১০, ২০ অথবা ৩০ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট দিয়ে রাজধানীতে প্রসাধনের লেপন দিয়েছেন, এর বাইরে কিছু করা হয়নি। রাজনীতিতে কয়েকটি ফ্লাইওভার বানিয়ে, মেট্রোরেল দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন হবে না দাবি করে তিনি বলেন, এদেশের অর্থনীতির মূল শেকড় গ্রামে কোনো উন্নতি হয়নি। গ্রামীণ অর্থনীতির অবকাঠামোকে তারা লোপাট করে দিয়েছেন। যেটা আমরা ১৯৯১-৯৬ এবং পরবর্তীতে ২০০১-২০০৭ সালে ক্ষমতায় থেকে গড়ে তুলেছিলাম। বিদেশি বিনিয়োগ না আসার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগও বাড়েনি দাবি করে তিনি একে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার প্রকাশ হিসেবে দেখছেন। এফডিআই বিনিয়োগ নথিতে ঠিক রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে একটি ডলারও বিনিয়োগ হয়নি। তার চেয়ে মারাত্মক এই যে, দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তারাও গত কয়েক বছরে একটি টাকাও বিনিয়োগ করেননি। কারণটি স্পষ্ট, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। যদি সরকার বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে একদলীয় শাসন কায়েম করে, তাদের দলীয় ব্যবসায়ীদের প্রমোট করে, তাহলে তো সত্যিকার বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবে না। সেটাই হয়েছে বাংলাদেশে।
অর্থ পাচারের মহীসোপানে: বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে দাবি করেন সাবেক মন্ত্রী মঈন খান।
তিনি বলেন, সুইস ব্যাংকে বিগত বছরের জমা টাকার যে হিসেব দেখেছেন আপনারা, সেটি বাংলাদেশ থেকে গেছে। এতো টাকা সুইস ব্যাংকে গেল? এই দরিদ্রতম দেশ থেকে এতো টাকা কীভাবে গেছে। এখন বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ নাকি উন্নয়নের মহীসোপানে গেছে। হ্যাঁ, ঠিক আছে, টাকার পাচারের মহীসোপানে গেছে। যারা অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ মনে করছেন না, তারা টাকা সরিয়ে নিচ্ছেন।
লুটপাটে ফাঁপা অর্থনীতি: গোটা দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দাবি করে মঈন খান বলেন, অর্থনীতি ফাঁপা হয়ে গেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ফাঁপা হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম অর্জন হিসেবে দেখানো পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘হরিলুট’ চলছে বলেও দাবি করেন তিনি। দুর্নীতির দায়ে বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত পদ্মা সেতু প্রকল্প নিজ অর্থায়নে করার নামে চলেছে দরিদ্র জনগণের পকেট কাটা। প্রতিটি খাতে অতিরিক্ত লেভি আরোপ করা হয়েছে। সবাই এর শিকার। ১৬ কোটি মানুষ থেকে ৫ টাকা ১০ টাকা নিলে প্রতিদিন কতো কোটি টাকা আসে? চলছে কী? সেই অর্থের হরিলুট। কীভাবে ‘হরিলুট’ হচ্ছে তার একটি ব্যাখ্যাও দেন বিএনপি নেতা।
এই পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা যখন হয়, তখন আমরা সরকারের ছিলাম। মূল পরিকল্পনায় ব্যয় ছিলো ১০,০০০ হাজার কোটি টাকা। তা এখন ২৮ হাজার কোটি টাকাতে এসে ঠেকেছে। আমি বুঝতে পারি, সময়ের সাথে বাড়তে পারে। তাই বলে কি ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা হবে! আমি আশ্চর্য হব না, এই প্রকল্প শেষ পর্যায়ে যদি ৫০ হাজার কোটিতে গিয়ে ঠেকে। ফ্লাইওভার প্রকল্পগুলোতেও ব্যয় তিন-চারগুণ বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেন মঈন খান। আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন হলেও জ্বালানি তেলের দাম না কমিয়ে সরকার সেখান থেকেও অর্থ লুট করছে বলে তার দাবি। আজকে জ্বালানি তেলের দাম ১২০ ডলার থেকে ৩০ ডলারের নিচে নেমে গেছে, অর্থাৎ চার ভাগের এক ভাগ। তাহলে কেন সরকার আমাদের কাছ থেকে ৯৯ টাকায় করে পেট্রোলের দাম নিচ্ছেন। ১২০ ডলারের পেট্রোল যদি ৩০ ডলার হয়ে থাকে, তাহলে এক লিটারের পেট্রোলের দাম ২৫ টাকা হওয়ার কথা। তাহলে ৭৫ টাকার কার পকেটে যাচ্ছে?