পুলিশ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গাংনী আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় শোক-প্রতিবাদ

চিহ্নিত মাদকব্যবসায়ীরা বহাল তবিয়তে থাকায় চরম ক্ষোভ
মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুর গাংনী উপজেলার পীরতলা পুলিশ ক্যাম্পের কনস্টেবল আলাউদ্দীন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও শোক প্রকাশ করেছেন মেহেরপুর গাংনী উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্যবৃন্দ। গতকাল বৃহস্পতিবার উপজেলা সভাকক্ষে চলতি মাসের সভায় পুরোটাই জুড়ে আলোচনায় ছিলো হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি। ঘটনার কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও সীমান্ত এলাকার চিহ্নিত শীর্ষ মাদকব্যবসায়ীরা আটক না হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমিটির সদস্যবৃন্দ। এছাড়াও পল্লী বিদ্যুত ও হাসপাতালের সেবা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে।
গাংনী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুরাদ আলীর সভাপতিত্বে ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল আমিনের পরিচালনায় বেলা ১১টার দিকে সভা শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভার পর উপজেলা মাসিক সমন্বয়সভা থাকায় দুটি কমিটির সদস্যবৃন্দ সভায় উপস্থিত হন। ফলে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভার মধ্যেই সমন্বয় কমিটির কয়েকটি বিষয়ের আলোচনা উঠে আসে। সভার শুরুতেই পুলিশ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন আইনশৃঙ্খলা কমিটির কয়েকজন সদস্য।
বক্তৃতায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহিদুজ্জামান বলেন, গত ২৪ জুলাই সাহেবনগর তালতলা নামক স্থানে মাদকব্যবসায়ীদের মাইক্রোবাস থামাতে গিয়ে পীরতলা পুলিশ ক্যাম্পে কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল আলাউদ্দীন মৃত্যু বরণ করেন। ঘটনার পর এলাকার মানুষ হত্যাকাণ্ড বলে জানায়। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। এ নিয়ে মানুষের মাঝে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। আলাউদ্দীনকে হত্যা করা হয়েছে নাকি সড়ক দুর্ঘটনা তা স্পষ্ট করার দাবি জানান তিনি। বিষয়টি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন কয়েকজন সদস্য। কমিটির আরও কয়েকজন সদস্যর মতামত উপস্থাপনের পরে গাংনী থানার এসআই মনিরুজ্জামান স্বীকার করেন যে, তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সাহিদুজ্জামান খোকন হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ ও শোকপ্রস্তাব করেন। এদিকে হত্যাকারীদের কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মাদকব্যবসা ও মাদকব্যবসায়ীদের সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেন সাহিদুজ্জামান খোকন। তিনি বলেন, কাজিপুর, হাড়াভাঙ্গা, তেঁতুলবাড়ীয়াসহ সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে কয়েকজন শীর্ষ মাদকব্যবসায়ী দাপটের সাথে মাদকব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আলাউদ্দীন যেহেতু মাদকপাচারকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন তাই ওই এলাকার মাদকব্যবসায়ীদের নির্মূল করা জরুরি। কিন্তু ঘটনার কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও কোনো মাদকব্যবসায়ী গ্রেফতার তো দূরে থাক, তাদের ধরতে অভিযান চালানো হয়নি। একজন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পরেও যদি মাদকব্যবসায়ীরা বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালায়, তাহলে মাদকব্যবসায়ীরা কী পুলিশের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর কি-না প্রশ্ন রাখেন তিনি। ঘটনার রাতে পুলিশের বিভিন্ন স্থানের টহল উপেক্ষা করে কিভাবে মাইক্রোবাসটি পালিয়ে গেলো তাও জানতে চান তিনি। মাদক ও অস্ত্রব্যবসায়ীদের কারণে এলাকায় অপরাধীদের জন্ম হয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এদের নির্মূল করা না গেলে সীমান্ত এলাকার অপরাধ দমানো সম্ভব হবে না।
সীমান্ত এলাকার মাদক নিয়ন্ত্রণে বিজিবিকে আরো সক্রিয় হওয়ার দাবি করেন কয়েকজন সদস্য। মাদকব্যবসায়ী গ্রেফতার না হওয়া ও সীমান্তে মাদক পাচার নিয়ে নানাবিধ অভিযোগ করেন তারা। সীমান্ত রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজসহ চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি সব সময় সতর্ক বলে জানান বিবিজি কাথুলী কোম্পানি কমান্ডার। হত্যকাণ্ড ও তার পরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পুলিশের নেয়া পদক্ষেপের বিষয়টি খোলাসা করেন এসআই মনিরুজ্জামান। আসামি গ্রেফতার ও মামলা তদন্তের স্বার্থে সব কিছু বলা যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, গোটা পুলিশ প্রশাসন শোকাহত। এ বিষয়ে যা যা করা দরকার পুলিশের পক্ষ থেকে তাই করা হচ্ছে। এদিকে মাদক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পল্লী বিদ্যুতের মিটার অর্থের বিনিময়ে লাগানোর প্রতিবাদ জানান সাহিদুজ্জামান খোকন। তিনি পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সাধারণ মানুষ আবেদন করলে মিটারের জন্য ঘুরতে হয়। অথচ ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিলেই মিটার পাওয়া যায়। শুধু টাকার বিনিময়ে মিটার স্থাপন নয় আবেদন ছাড়াই বিভিন্ন গ্রামে মিটার স্থাপনের বিষয়ে অভিযোগ ওঠে। বেশ কিছুদিন ধরে কয়েকটি গ্রামে অবৈধ সংযোগ দিলেও এর বিরুদ্ধে পল্লী বিদ্যুতের পক্ষ থেকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তীব্র সমালোচনা করা হয়। পল্লী বিদ্যুতের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা না নিলে তাদের বিরুদ্ধে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে বলে হুশিয়ারী করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল আমিন। তিনি বলেন, প্রতি মাসের সভায় পল্লী বিদ্যুতের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। আগামী সভায় আর কোনো অভিযোগ যেন না ওঠে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গাংনী জোনাল অফিসের ডিজিএমকে বলেন তিনি। শুধু পল্লী বিদ্যুত কিংবা পুলিশ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নয়, গাংনী হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিয়েও আলোচনা হয়।
হাসপাতালের আরএমও ডা. এমকে রেজা জানান, দীর্ঘদিন ধরে অপারেশন থিয়েটার বন্ধ থাকায় ডিএসএফ কার্ডধারী গরিব রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। হাসপাতালের সার্বিক সেবা প্রদানে কমিটির সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। এ বিষয়ে সদস্যদের আলোচনায় উঠে আসে নানান অসঙ্গতি ও হাসপাতালের চিকিৎসক এবং নার্সসহ বিভিন্ন পদের কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলার খণ্ড চিত্র। গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনী) ডা. আলাউদ্দীন নানা অজুহাতে অপারেশন বন্ধ রেখেছেন। তিনি গাংনীর দুটি ক্লিনিকে নিয়মিত সিজারিয়ানের কাজ করেন। ওই ক্লিনিক দুটির ব্যবসার স্বার্থেই তিনি হাসপাতালে অপারেশন বন্ধ রেখেছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়। দায়িত্বে অবহেলার ঘটনায় ডা. আলাউদ্দীনের বেতন বন্ধের জন্য উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে চিঠি দেয়া হবে বলে সভায় সাফ জানিয়ে দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। তিনি বলেন, এর আগেও তাকে সতর্ক করা হয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে অপারেশন চালু না হলে আজকের সভার রেজুলেশনসহ তার বেতন বন্ধের জন্য বলা হবে। হাসপাতাল দালাল মুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্তের কথাও বলেন তিনি।
আলোচনায় আরো অংশ নেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ খালেক, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান লাইলা আরজুমান বানু, গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, জেলা আ.লীগের সাবেক কৃষি বিষয়ক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম শাহ, পৌর আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মো. মহসিন আলী, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মুন্তাজ আলী, তেঁতুলবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা বিশ্বাস, কাজিপুর ইউপি চেয়ারম্যান মুহা. আলম হোসাইন, সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম অল্ডাম, জুলফিকার আলী কানন, মজনুর রহমান আকাশ, মাজেদুল হক মানিক ও এমএ লিংকন।
সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ খালেক বলেন, সীমান্ত এলাকার শীর্ষ মাদকব্যবসায়ীদের সাথে পুলিশ কিংবা বিজিবির আতাত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। মাদকব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে পুলিশের আন্তরিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আলাউদ্দীনের ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে প্রেসবিফ্রিং করলে বিষয়টি পরিষ্কার হতো। বিষয়টি খাটো করে দেখার সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারপূর্বক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে আইনের শাসন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। হাসপাতালের সার্বিক অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে যার যার অবস্থান থেকে ভুমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।
সমাপনি বক্তব্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, উপজেলা পরিষদ হচ্ছে একটি মিনি পার্লামেন্ট। উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি উপজেলার সব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন হয়। তাই দাপ্তরিক অর্পিত সকল দায়িত্ব ভালভাবে পালনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশ দেন তিনি। বারবার শুধু অনুরোধ কিংবা চিঠিপত্র চালাচালির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আজকের আলোচনা ও সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো আগামি মাসিকসভার আগেই সমাধান করতে সকলের প্রতি তাগিদ দেন তিনি। সভা শেষে নিহত আলাউদ্দীনের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া মোনাজাত পরিচালনা করেন হাজি মো. মহাসিন আলী। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ, জড়িতদের গ্রেফতারপূর্বক শাস্তি নিশ্চিত ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়।