পাখিদের প্রতি ভালোবাসার নজির পাখিগ্রাম বেলগাছী

আহসান আলম: শুরুতেই শুভ্রদেবের জনপ্রিয় সেই গানের কলিটি মনে পড়ে গেলো, ‘শিশুকালে মা শোনাতো ঘুম পাড়ানি গান, ভোরের বেলায় ঘুম ভাঙাতো পাখির কলতান’। এ গানের মতোই ভোর হলেই কিচিরমিচির, কূজন কূজন কলকাকলিতে মুখর করে তোলে নানা প্রজাতির পাখি। গ্রামের নাম বেলগাছি। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার এই গ্রামের মানুষ কেউ পাখি শিকার করে না। গ্রামের এক পেঁয়াজু বিক্রেতা আলফা তার অবশিষ্ট ভাজাভুজি পরদিন ভোরে পাখিদের খাইয়ে তৃপ্তিবোধ করেন। শীত এলে দেশি বিদেশি নানা প্রজাতির হাজারও পাখির আনাগোনা হয় বেলগাছি গ্রামে। গ্রামের এক পাশ দিয়ে মাখালডাঙ্গা অভিমুখে একটি সড়ক চলে গেছে। এ সড়কের ধারে একটা বিল আছে, যার দৈর্ঘ্য ৩ কিলোমিটারেরও বেশি। এই বিলে সারস, শামুকখোল, বক, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আসতো এক সময়। তখন এলাকার কিছু মানুষ অবাধে পাখি শিকার করতো। সেসময় বেলগাছির দু’সন্তান গাইদঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বখতিয়ার হামিদ বিপুল ও চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের ছাত্র আরিফুজ্জামান মিলে পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। তারা প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন গাছে কলস ও ঝুড়ি টাঙিয়ে দেন পাখি সংরক্ষণের জন্য। দুজনের এ উদ্যোগ দেখে প্রথমে এলাকার অনেকেই তাদের পাগল বলে টিটকারি মারতো, তাচ্ছিল্য করতো। কিন্তু মানুষের উপহাস দেখে তারা ভেঙে পড়েননি। পাখিদের প্রতি দরদ আর ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যান ধীরে ধীরে। এক সময় গ্রামের তরুণ, কিশোরসহ সব বয়সী মানুষ এগিয়ে আসে তাদের সহযোগিতার জন্য। শুরুটা ছিলো ২০০৭ সালে। পাখি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন টাকা। এই টাকার যোগান দিতে শিক্ষক বিপুলের পাশাপাশি আরিফুজ্জামান বখতিয়ার শুরু করেন টিউশনি। প্রতিমাসে যে টাকা রোজগার করেন তার সবই তিনি খরচ করেন পাখি সংরক্ষণের বিভিন্ন কাজে। ওই এলাকার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাদের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে একত্রিত করে একটি ফান্ড তৈরি করে। এলাকার পৌর কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মনি তাদেরকে সবসময় উৎসাহ দিয়ে আসছেন বিভিন্নভাবে। অসুস্থ পাখির চিকিৎসার জন্য বিপুল ও বখতিয়ার চুয়াডাঙ্গা ভেটেরিনারি থেকে প্রশিক্ষণ নেন এবং গড়ে তোলেন একটি পশুপাখির চিকিৎসা কেন্দ্র। বর্তমানে বেলগাছি, মাখালডাঙ্গাসহ আশপাশ এলাকার বিভিন্ন গাছে দেড়হাজারেরও বেশি ভাঁড় ও ঝুড়ি দেয়া আছে পাখি সংরক্ষণের জন্য। শিক্ষক বিপুল ছুটি পেলে চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশের স্কুলে পাখি ও পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করেন, গান শুনিয়ে তাদেরকে উৎসাহিত করেন। কিছু প্রভাবশালী লোক অবৈধভাবে এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার করেন। এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় খুঁজছেন তারা। ফসলে কীটনাশক ও ঘাসমারা বিষ ছিটানোর কারণে পশুপাখিদের ক্ষতি হচ্ছে। সম্প্রতি খুলনা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া এক সফরে বেলগাছি গ্রাম পরিদর্শন করেন। পাখি সংরক্ষণের কথা শুনে তিনি খুশি হন এবং তাদেরকে সার্বিকভাবে সহায়তার আশ্বাস দেন। বিভিন্নস্থান থেকে খবর পেয়ে বর্তমান জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ তাদেরকে সার্বিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। বর্তমানে স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রী মিলে ৮০ জনেরও বেশি সদস্য রয়েছেন পাখপাখালির সেবার কাজে। এদের মধ্যে শাহীন, সোহেল, নাজমুল, জিনারুল, সিজান, সাব্বির, আলিফা ও মারুফা অন্যতম।