পাখিগ্রাম আলমডাঙ্গার সেনবণ্ডবিল

রহমান মুকুল: আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার ব-বিল গ্রামের উত্তরপাড়া বা সেনব-বিল পাখিগ্রাম নামে পরিচিত হয়ে উঠছে। সেনবণ্ডবিলের বাঁশবাগান জুড়ে বহু প্রজাতির হাজার হাজার পাখির আবাসস্থল। আলমডাঙ্গা পৌরসভার ব-বিল গ্রামের উত্তরপাড়ার পাশ ঘেষে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের সাইড ক্যানেল। ক্যানেলের একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত শ্যামলিম ফসলিল আবাহন। সারাদিন বাসন্তি বাতাস ঘন সবুজ ধানক্ষেতে বিলি কেটে কেটে ক্যানেলের অপর পারের এ বাঁশবাগানে দাঁপিয়ে বেড়ায় পাখিরা। সন্ধ্যার আবছায়া ঘণায়িত হওয়ার আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে ক্লান্ত-শ্রান্ত পাখিরা বাঁশবাগানের কুলায় ফিরে আসে। এরপর শুরু করে বিরতিহীন সংগীত লহরী। বাঁশবাগানসহ গাঁয়ের এপাড়া পাখিরা কূজন-কাকলিতে মুখরিত করে তোলে। পাখিদের আবাসস্থল বাঁশবাগানের নিকটবর্তী মানুষের বিড়ম্বনার অন্ত নেই। পাখির সম্মিলিত ঐকতান স্থানীয়দের গা-সওয়া হয়ে উঠলেও তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনরা যারপরনাই বিরক্ত হন। পড়ন্ত বিকেলের ধুপছায়া রোদ্দুর, শান্ত সন্ধ্যার রহস্যঘন মায়াবী পরশে সমস্ত গ্রামজুড়ে অপার্থিব নীরবতা বিরাজ করলেও এপাড়া তখন মুখর পাখির সম্মিলিত কলতানে।
কুলায় ফেরা পাখিদের জমে ওঠা হাটে গিয়ে হাজির হই। পাড়াব্যাপী বেশ কিছু বাঁশঝাড়, ভেটুল গাছে পাখিদের এ শান্তি-সুখের ঘরবসতি। বলতে গেলে তাদের আবাসভূমির মাঝে ২-১টি মনুষ্য পরিবারের অযাচিত বসবাস। এমনি একটি বাড়ির গৃহস্থ নজরুল ইসলাম ও কাজলী খাতুন। কাজলী খাতুনের সাথে কথা বলে জানা গেলো, পাখির আবাসস্থলের বাগানের মালিক অনেকে। দীদার ম-ল, আনসার ম-ল, কাবিল হোসেন, মুসা হক। কাজলী খাতুন বলেন, ভোরবেলা যখন আজান হয় তখন থেকে সকাল ও সন্ধ্যার আগ থেকে মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত এদের ডাকে এলাকা মুখর থাকে। প্রথম প্রথম অসহ্য লাগতো। লগি দিয়ে তাড়াতাম, ঢিল মারতাম। ঘুমাতে পারতাম না। এখন অবশ্য সহ্য হয়ে গেছে। নিরদ্রুপ পরিবেশে হাজার হাজার শাল্কি, গাং শালিক, ডাহুক, ঘুঘু, টিয়া, ক্যাচমেচাসহ অসংখ্য পাখি এখানে অবাধে বসবাস করছে।
আলমডাঙ্গা শহরের নিকটবর্তী স্থানে পাখিদের এমন নিশ্চিন্ত আবাসস্থল, এমন অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে তা না দেখলে অবিশ্বাস্য। ব-বিলের এ পাড়া ক্রমেই পাখিগ্রাম নামে পরিচিত হয়ে উঠছে।
আবহমান বাংলায় কোকিলের কুহুতান বসন্তের আগমন বার্তা বয়ে আনে। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই সুর এখন আর শোনা যায় না বললেই চলে। শকুনকে বলা হতো প্রকৃতির সুইপার। তাদের প্রধান খাদ্য ছিলো গ্রামের ভাগাড়ে ফেলে দেয়া মৃত গরু-মোষসহ বিভিন্ন পশু। সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন মৃত প্রাণী ভাগাড়ে রাখা হয় না। মাটি চাপা দেয়া হয়। খাবারের অভাবে এ অঞ্চলের শকুন হারিয়ে গেছে। একইভাবে হারিয়ে যাচ্ছে সাহেব বুলবুলি, টিয়ে, শালিক, ময়না, কাটঠোকরা, চিল, কুজঝুটি প্রভৃতি পাখির প্রজাতি। শিকার ছাড়াও বন-জঙ্গল কমে আসায় পাখির আবাসস্থল সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। খাবারের অভাবও আছে। পাখির প্রধান খাবার ছিলো বনের ফলমূল। এখন তা নেই বললেই চলে। যথেচ্ছা কীটনাশক ব্যবহারের ফলেও পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে প্রাণিবিজ্ঞানীরা মনে করছেন। দেশীয় পাখি ছাড়াও প্রতি শীত মরসুমে ভিন দেশ থেকে অতিথি পাখির আগমন ঘটতো এ অঞ্চলে। সেরকম আলমডাঙ্গার ব-বিলের উত্তরপাড়ার এ পাখিগ্রাম সংরক্ষণে সকলকে দায়িত্ব নেয়া উচিত বলে মনে করে সচেতনমহল।