পঞ্চগড়ে মঠের অধ্যক্ষকে গলা কেটে খুন

1456059490

স্টাফ রিপোর্টার: এবার পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে একটি মঠে গিয়ে যজ্ঞেশ্বর রায় (৫০) নামে ওই মঠের অধ্যক্ষকে গলাকেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। হত্যার কারণ তাত্ক্ষণিকভাবে জানা না গেলেও হামলার ধরন অনেকটাই গত বছরের বিদেশি এবং যাজকদের ওপর আক্রমণের মতো বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় উঠে এসেছে। দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন আরও দুজন। গতকাল রোববার সকালে দেবীগঞ্জ উপজেলা শহর লাগোয়া শ্রী শ্রী সন্ত গৌড়ীয় মঠে এ ঘটনা ঘটে। স্বজনরা বলছেন, যজ্ঞেশ্বর রায়ের সাথে কারো কোনো বিরোধ ছিলো না। কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে তাও বুঝছেন না। এর আগে রংপরে জাপানি নাগরিক কুনিয়ো হোসিকেও একইভাবে হত্যা করা হয়।
হামলাকারীদের ব্যাপারে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবীর জানিয়েছেন, হামলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে- হামলাকারীরা কোনো না কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। আদর্শিক কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে। সম্ভাব্য খুনিদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে বলেও জানান তিনি। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।
আহতরা হলেন- পূজারী গোপাল চন্দ্র রায় (৩৫) ও নিতাই পদ দাস (৪০)। এছাড়া ঘটনার পর আতঙ্কিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নিতাইয়ের বৃদ্ধা মা চিরতা রাণী (৬০)। গুলিবিদ্ধ গোপালকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও ককটেলের আঘাতে আহত নিতাই পদ দাসকে দেবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি তাজা ককটেল ও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি চাপাতি উদ্ধার করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দেবীগঞ্জ উপজেলার করতোয়া নদীর পশ্চিম পাশে ব্রিজ সংলগ্ন শ্রী শ্রী সন্ত গৌড়ীয় মঠ। সকাল সাতটার দিকে ওই মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়সহ তিনজন পূজারিসহ পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা মঠের বাইরে থেকে ঢিল ছোঁড়ে। শব্দ শুনে বেরিয়ে আসেন যজ্ঞেশ্বর রায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার গলাকেটে খুন করে। ভয়ে গোপাল চন্দ্র পালানোর চেষ্টা করলে তাকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। গুলি তার পা ও হাতে বিদ্ধ হয়। দুর্বৃত্তরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় বেশ কয়েকটি ককটেল নিক্ষেপ করে। এতে আহত হয় নিতাই পদ দাস।
আহত গোপাল চন্দ্র রায় সাংবাদিকদের বলেন, তোর গুরুজীকে কতল করা হয়েছে বলেই তার ওপর গুলি চালিয়েছিলো দুর্বৃত্তরা। বাম হাতে দুটি জখম নিয়ে গোপাল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেন। গুরুজীর শরীর ভালো না। সকালে মঠের রান্না ঘরে তার জন্য রুটি বানাচ্ছিলাম। ওই সময় গুরুজীর সুস্থতা কামনায় গুণগুণ করে কীর্তন গাইছিলাম। সকাল ৬টা কি সাড়ে ৬টা হবে। এমন সময় গুরুজীর আর্তচিত্কার শুনতে পাই। গোপাল রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে পান তার গুরুজীর ঘর থেকে বের হচ্ছেন দুজন লোক। তাদের পরনে প্যান্ট ও জ্যাকেট। জ্যাকেটের সাথে থাকা টুপি দিয়ে তাদের মাথা ঢাকা।
আমাকে দেখা মাত্র ওই দুজন কোমর থেকে পিস্তল বের করে বলতে থাকে, ওই ঘরে যাবি তো তোকেও কোতল করবো। তোর গুরুজিকে কতল করা হয়েছে। তোরা বড় আনন্দে আছিস, রান্নাঘরে কীর্তন গাইছিলি-বলেই আমার বুক বরাবর গুলি ছুঁড়তে থাকে ওরা। গোপাল জানান, হামলাকারীদের পিস্তলে গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। গুলি আবার ভরার সময় তিনি মঠের একটা দেয়াল টপকে পার হয়ে চিত্কার করে পালিয়ে যান। শোরগোল শুনে মাঠের পাশের বাড়ি থেকে নির্মল চন্দ্র বর্মন নামে আরেকজন বেরিয়ে আসার সময় হামলাকারীর সামনে পড়েন। তবে তিনি হামলাকারীদের এড়াতে পারলেও পালানোর সময় আহত হয়েছেন। দেবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিত্সাধীন নির্মল বলেন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। চিত্কার শুনে ঘুমের ঘোরে দরজা দিয়ে বাইরে আসতেই দেখি একজন গুরুকে ছুরি (চাপাতি) দিয়ে কোপাচ্ছে। এ সময় মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে পিস্তল হাতে উঠতে থাকা একজন নিচে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমি দৌড়ে আরেক দরজা দিয়ে বেরিয়ে পালাই।
এদিকে হত্যার প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও স্থানীয় সনাতন ধর্মালম্বীরা। দুপুরে দেবীগঞ্জের করতোয়া ব্রিজ সংলগ্ন পঞ্চগড়-দেবীগঞ্জ মহাসড়কে এ অবরোধ রাখে। এ সময় দেবীগঞ্জ-পঞ্চগড় মহাসড়কের দু পাশে শ শ গাড়ি আটকা পড়ে। পরে পুলিশের কাছ থেকে আসামিদের গ্রেফতারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করেন বিক্ষুব্ধরা।
ঘটনাস্থল পরির্দশন করে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি বলেন, হত্যার পদ্ধতি ও হামলা ধরন দেখে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে এরা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। জাপানি নাগরিককে হত্যার সময় এক মোটরসাইকেলে তিনজন ছিলো। এখানেও তাই। তিন মোটরসাইকেল আরোহীর মাথায় ছিলো হেলমেট। এদের মধ্যে দুজন সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। একজন মোটরসাইকেল চালু অবস্থায় রাস্তায় অপেক্ষা করে। ৪ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে দ্রুত তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যজ্ঞেশ্বর রায়ের সাথে কারো কোনো বিরোধ ছিলো না।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে পঞ্চগড় পুলিশ সুপার গিয়াসউদ্দিন আহমদ বলেন, কারা হত্যাকারী এবং কী কারণে এমন হলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত না করে কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ গোপাল স্থানীয় একটি কলেজের পিয়ন। আর বিস্ফোরণে আহত নিতাই চন্দ্র রায় স্থানীয় বাসিন্দা। পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, সারাদেশে যারা মসজিদ মন্দিরে হামলা করছে এটাও তাদেরই কাজ। সরকার এসব জঙ্গি দমনে সচেষ্ট আছে। পঞ্চগড়ের দক্ষ পুলিশ প্রশাসনও এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
কে এই অধ্যক্ষ: যজ্ঞেশ্বর রায়ের বাড়ি একই উপজেলার সোনাহারে। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে। তিনভাই দু বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বিয়ে করেননি। নিহতের ভাই রবীন্দ্র রায় বলেন, তার দাদা ১৯৯৮ সালে মঠটি প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তিনি মঠের অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন। মঠে তিনি একাই থাকতেন। তবে মঠটি প্রতিষ্ঠার সময় স্থানীয় একজনের সাথে জমি নিয়ে কিছুটা বিরোধ ছিলো। পরে তা ঠিক হয়ে যায়। এছাড়া কারো সাথে তার বিরোধ নেই।