দেশি বিনিয়োগে বেশি বঞ্চনা : বিদেশিদের ক্ষেত্রে উল্টোচিত্র

 

স্টাফ রিপোর্টার: বিশ্বজুড়ে বিদেশি বিনিয়োগ টানার মন্ত্র একটাই, আগে দেশি বিনিয়োগকারীদের সন্তুষ্ট করা। তারা যখন বিপুল মাত্রায় বিনিয়োগ শুরু করেন, তখন সে তথ্য পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন বিদেশিরা। দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে আলোচনা করে ব্যবসার পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা নেন। তারপর তারা আসেন বিনিয়োগ নিয়ে। কখনো একক মালিকানায়, কখনো বা যৌথভাবে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। বাংলাদেশে যেন এর উল্টো দৃশ্য। এখানে নানা সুবিধা দিয়ে বিদেশিদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চলছে। বিদেশে গিয়ে রোড শো করা হচ্ছে। আর নানা প্রতিবন্ধকতায় আটকে থাকছে দেশি বিনিয়োগ। ফলে দেশি কিংবা বিদেশি কোনো ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ মিলছে না।

বিনিয়োগ বোর্ডের ওয়েবসাইটে বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে কেনো বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবেন। সেখানে মুনাফাসহ শতভাগ মূলধন ফেরত নেয়ার সুযোগ দেয়ার কথা বলা আছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিনিয়োগ করলে পাঁচ বছরের এবং এই দুই জেলার বাইরে বিনিয়োগ করলে সাত বছরের কর অবকাশ সুবিধার ঘোষণা রয়েছে সেখানে। তাঁদের জন্য আমদানি-রফতানি পর্যায়ে রয়েছে নানা রকমের নীতি সহায়তা। বিদেশি কম্পানিগুলো মুনাফা বা লভ্যাংশ পুনর্বিনিয়োগ করলে তা নতুন বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে একইভাবে কর অবকাশ সুবিধাসহ মিলবে অন্য সব সুযোগ-সুবিধা। নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় যন্ত্রপাতির জন্য প্রথম বছরে ৫০ শতাংশ অবচয় সুবিধা, দ্বিতীয় বছরে ৩০ শতাংশ এবং তৃতীয় বছরে ৩০ শতাংশ অবচয় সুবিধা দেয়া হয়। উৎপাদিত পণ্যের ৮০ শতাংশের বেশি রফতানি করলে শুল্কমুক্ত যন্ত্রাংশ আমদানি এবং আলাদা বন্ডেড ওয়্যারহাউজিং সুবিধা দেয়া হয়। এ ছাড়া এলসির বিপরীতে ৯০ শতাংশ ঋণ এবং রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ নেয়ার সুযোগও রয়েছে। ইপিজেডের বাইরে শতভাগ রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও স্থানীয় বাজারে একই শুল্কে ২০ শতাংশ পর্যন্ত পণ্য বিপণনের সুযোগ দেয়া হয়। সুনির্দিষ্ট কিছু পণ্যে ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে নগদ সহায়তা।

উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশি ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যেন ঠিক এর উল্টো। কর অবকাশ সুবিধা নেই। মুনাফার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধ করতে হয় করপোরেট কর বাবদ। এত বিপুল পরিমাণ কর দিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন বিনিয়োগ সম্ভব হয় না। রপ্তানিমুখী কয়েকটি খাতে নগদ সহায়তা থাকলেও আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন খাতে এ ধরনের কোনো সুবিধা নেই। বিদেশি উদ্যোক্তারা স্বল্প সুদে বিদেশ থেকে ঋণ নিতে পারেন সহজেই, দেশি উদ্যোক্তাদের জন্য বিদেশি তহবিল থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ উন্মুক্ত হলেও হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে এ সুবিধা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, দেশে বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হয়। উৎপাদন বাড়লে জিডিপির প্রবৃদ্ধিও বাড়ে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশীয় উদ্যোক্তাদেরই বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। সব দেশেই স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি অনুসরণ করা হয়। কারণ স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়লে তাতে কোনো ঝুঁকি তৈরি হয় না। আর বিদেশিদের বিনিয়োগে ঝুঁকি তৈরি হয়। কোনো কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারী তাঁর পুঁজি প্রত্যাহার করে নিলে দেশের অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নানা প্রণোদনা দিয়ে আকৃষ্ট করার বদলে দেশি উদ্যোক্তাদের সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব দেন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমরা ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি। আমাদের অর্থনীতি স্থিতিশীল। তবু বিনিয়োগ হচ্ছে না। আমাদের অবশ্যই ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেবা নিশ্চিত করতে হবে। ঘুষ-হয়রানিমুক্ত সেবা দিতে হবে। দেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করে সন্তুষ্ট হলে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আর রোড শো করার দরকার হবে না। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার বিনিয়োগের বড় বাধা উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান ৬ শতাংশ। এটি ২ শতাংশের মধ্যে থাকা উচিত এবং কোনোমতেই ৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের আর্থিক খাতে খেলাপি, অনিয়ম ও ঋণ বরাদ্দে রাজনৈতিক প্রভাব উচ্চ সুদহারের জন্য দায়ী। আর এটাই পুরো বিনিয়োগ পরিবেশে ধস নামিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হলে সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার বিকল্প নেই।

সেনাসমর্থিত গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ব্যবসায়ীদের সমস্যা দূর করতে বেটার বিজনেস ফোরাম গঠন করা হয়েছিল। ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী পুরনো বিধি-বিধান বদলাতে গঠন করা হয়েছে রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন। সরকার পরিবর্তনের পর এ দুটি বিলুপ্ত হয়েছে, দেশি উদ্যোক্তাদের সমস্যা দূর করতে বিকল্প কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধনের পর সরকারি সংস্থাগুলো তাদের জন্য জমি নিশ্চিত করা এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহসহ নানা অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করছে দ্রুততম সময়ে। কিন্তু দেশি উদ্যোক্তারা এ ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কারখানা স্থাপনে জমিপ্রাপ্তিতে সরকারের কাছ থেকে সহায়তা মিলছে না। নিজ উদ্যোগে উচ্চমূল্যে জমি কেনার পরও গ্যাস ও পানি সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস নিয়ে যেকোনো সময় প্রশ্ন ওঠার ভয়, পরিবেশ আইনের আওতায় জমি ভরাট ও কারখানা স্থাপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ঝামেলা উতরে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গিয়ে পড়তে হয় বড় ধরনের সমস্যায়। সুদের হার সামান্য কমলেও এখনো দুই অঙ্কের কমে মিলছে না শিল্পের চলতি মূলধন ও মেয়াদি ঋণ। সঙ্গে রয়েছে কঠোর ঋণ পুনঃ তফসিল নীতিমালা।

হয়রানি বন্ধে বিনিয়োগ বোর্ডে ব্যবসায়ীদের ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালুর দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। সেটি হলেও সেখানে কোনো ধরনের সার্ভিসই পাওয়া যায় না। সরকার বিনিয়োগ বোর্ডের কাজে গতি আনতে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন ও বিনিয়োগ বোর্ড একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য প্রণয়ন করা খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় পাস হলেও এখনো সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করা হয়নি। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নিজেদের কর্তৃত্ব বিনিয়োগ বোর্ডের হাতে ছেড়ে দেয়ার পক্ষেও না। ফলে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘুরে ঘুরে বিনিয়োগ সেবা পেতে হয় কখনো ঘুষ দিয়ে, কখনো উচ্চ পর্যায়ে তদবির করে।

স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, উৎপাদনশীল খাত তো বটেই, অনুৎপাদনশীল খাতেও বিদেশি  বিনিয়োগ এলে সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে দ্রুত গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু দেশের শিল্পমালিকরা বিপুল পরিমাণ অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে বছরের পর বছর বসে থাকলেও সেখানে এসব সেবা সরবরাহ করা হচ্ছে না। উল্টো বিনিয়োগের পর উৎপাদনে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সেবা পেতে সরকারের দপ্তরগুলোতে গিয়ে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের হয়রানি হতে হয় পদে পদে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভূমির বন্দোবস্ত করতে সরকার ইপিজেড প্রতিষ্ঠা এবং বিদেশিদের ইপিজেড করার জন্য ভূমির ব্যবস্থাও করছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগের পর গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে বছরের পর বছর অচল পড়ে থাকা কারখানার যন্ত্রপাতি একদিকে নষ্ট হয়, অন্যদিকে বাড়তে থাকে ঋণের সুদের ভার। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই স্থানীয় উদ্যোক্তাদের খেলাপি হতে হচ্ছে অহরহ। অর্থ মন্ত্রণালয়, বিনিয়োগ বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো বিষয়টি উপলব্ধি করলেও এর সুরাহা করার কোনো উদ্যোগ নেই তাদের।

দেশের একজন বড় শিল্পপতি কালের কণ্ঠকে বলেন, স্থানীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধা ও জটিলতাগুলো অব্যাহত থাকলে দেশি শিল্পপতিরা বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন না। তাঁরা বরং অর্থপাচার করে বিদেশে বিনিয়োগেই উৎসাহিত হবেন। এরই মধ্যে অনেক শিল্পপতি অর্থপাচারের মাধ্যমে বেনামে ভারত, মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশে শিল্প-কারখানা ও ভূমিতে বিনিয়োগ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নেতিবাচক পরিস্থিতি দূর করতে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে জমি নিশ্চিত করাসহ সময়মতো প্রয়োজনীয় গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সেবাদানকারী দপ্তরগুলোতে ঘুষ, দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে হবে।

চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে স্বীকার করে তা দূর করার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা নানা ধরনের সমস্যার কথা বলে থাকেন। যার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ, গ্যাসপ্রাপ্তিতে বিলম্ব, বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকরণে প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা, নিষ্কণ্টক জমির অভাব, ঋণের উচ্চ সুদহার ইত্যাদি। এসব বাধা অপসারণে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। বিনিয়োগ বোর্ড ও প্রাইভেটাইজেশন কমিশন একীভূতকরণের কাজ দ্রুত শেষ করার আশা রাখি। নতুন এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে সত্যিকার অর্থেই ‘ওয়ানস্টপ’ সেবা প্রদানের উপযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

অবশ্য দেশি উদ্যোক্তাদের বঞ্চিত হওয়ার তথ্য স্বীকার করতে নারাজ বিনিয়োগ বোর্ড। বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান এস এ সামাদ গত জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনে দেশি উদ্যোক্তাদের বঞ্চনার অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, ‘বাংলাদেশে মোট বিনিয়োগের ৯০ শতাংশই স্থানীয়, বাকি ১০ শতাংশ বিদেশি। এটি মাথায় রেখেই আমরা নীতি গ্রহণ করি।’

দেশি বিনিয়োগে হয়রানি-ঘুষ-দুর্নীতির বাধা নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মুনাফা করার অনেক সুযোগ রয়েছে। ছোট দেশে ১৬ কোটি মানুষ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার চেয়েও বড়। বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মধ্যে প্রণোদনায় তেমন তফাত নেই। কিন্তু দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কম। এত সুবিধা সত্ত্বেও কেন যে বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে এত কম বিনিয়োগ আসছে, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না!