ডাকা টানা ৪৮ ঘন্টা হরতালের শেষ ২৪ ঘন্টায় ২৪ জেলায় সহিংসতা

মাথাভাঙ্গা ডেস্ক: কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামীর ডাকা টানা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের শেষ ২৪ ঘণ্টায়ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। মেহেরপুরে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে দেলোয়ার হোসেন (৩৪) নামের এক জামায়াত কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ সময় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে পুলিশের পিকআপ ভ্যান।

লাগাতার হরতালে চুয়াডাঙ্গা ও রাজধানী ঢাকার সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত থাকলেও দেশের কয়েকটি জেলার অবস্থা ছিলো অশান্ত, উত্তপ্ত। হরতালের সমর্থনে কয়েকটি বিভাগীয় শহরসহ অন্তত ২৪ জেলায় পিকেটিং করছেন জামায়াত-শিবির কর্মীরা। তারা সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং বোমাবাজি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এ সময় বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে শিবির কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। গুলি ছুড়ে জামায়াত-শিবির কর্মীদের ককটেল বিস্ফোরণের জবাব দিয়েছে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে সহায়তা দেয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে বিজিবিও মোতায়েন করা হয়েছে।

মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, গতকাল সকালে মেহেরপুর শহরের উপকণ্ঠ বন্দর মোড়ে জামায়াত-শিবির সড়ক অবরোধ করে। এ সময় পুলিশ গিয়ে ছত্রভঙ্গ করতে গেলে অবরোধকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে অবরোধকারীরা পুলিশভ্যানে অগ্নিসংযোগ করে। অন্যদিকে মেহেরপুর মুজিবনগর সড়কের গৌরীনগর এলাকায় পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষ বাধলে মুজিবনগর থানার ওসি রবিউল ইসলামসহ চার জন পুলিশ কনস্টেবল এবং জামায়াত-শিবিরের ৮ জন আহত হয়েছে। এ সময় পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে এক জামায়াতকর্মী দেলোয়ার মারাত্মক আহত হয়। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার সে পথে মারা যায়। পুলিশ সুপার একেএম নাহিদুজ্জামান জানান, সকাল থেকেই জামায়াত-শিবির মারমুখি অবস্থান নেয়। পুলিশ অ্যাকশনে গেলে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।

মেহেরপুরে জামায়াত-শিবিরের হামলায় গুরুতর জখম সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আব্দুল মান্নানকে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে তাকে এ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সকালে মেহেরপুরে হামলার শিকার হওয়ার পর প্রথমে তাকে মেহেরপুর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে সিএমএইচ-এ স্থানান্তর করা হয়। সিএমএইচ-এর চিকিত্সক লে.কর্নেল মোখলেসুর রহমান জানিয়েছেন, জখম পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নানের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং তার বাম হাতের হাড় ভেঙে গেছে।

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে দু যাত্রীকে নিয়ে সিরাজগঞ্জগামী একটি অটোরিকশা চণ্ডিদাসগাতির বেইলি ব্রিজের কাছে পৌঁছুলে জামায়াত-শিবির কর্মীরা সেটিকে লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়ে। এ সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে অটোরিকশাটি রাস্তার পাশে উল্টে যায়। পরে জামায়াত-শিবির কর্মীরা অটোরিকশাটি ভাঙচুর এবং যাত্রীদের মারধর করে। এতে যাত্রী রায়গঞ্জের দেওভোগ গ্রামের মকবুল হোসেনের পুত্র মাসুদের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত লাগে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের উদ্ধার করে সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মাসুদ বিকাল ৪টার দিকে মারা যান।

চান্দনা চৌরাস্তা থেকে সকাল নয়টার দিকে ভিআইপি-২৭ নামের একটি যাত্রীবাহী বাস ঢাকা যাচ্ছিলো। এ সময় কয়েকজন শিবিরকর্মী যাত্রী বেশে বাসে ওঠে। বাসটি স্থানীয় বর্ষা সিনেমা হলের সামনে পৌঁছুলে ওই শিবির কর্মীরা কেরোসিন ও পেট্রোল ঢেলে বাসে আগুন ধরিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। এতে চালকসহ কমপক্ষে ১০ জন যাত্রী আহত হয়। অগ্নিদগ্ধ বাসচালক মহানগরের হায়দরাবাদ এলাকার নজরুল ইসলামকে (৪০) উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের তারগাছ এলাকায় ১০/১২ জন শিবিরকর্মী ককটেল ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় এলাকাবাসী ও ব্যবসায়ীরা জড়ো হয়ে আট শিবিরকর্মীকে আটক করে গণপিটুনি দেয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি ককটেল, গান পাউডার, কোরোসিন ও পেট্রোলের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে।

জামায়াতের ডাকা হরতাল চলাকালে বুধবার রাতে ঢাকা থেকে সার বোঝাই ট্রাক নিয়ে বগুড়া ফিরছিলেন চালক সামছুল হক (৫২)। তিনি ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে শেরপুর উপজেলার দশমাইল ঈদগাঁহ মাঠের সামনে পৌঁছুলে হরতাল সমর্থকরা ট্রাকের (ঢাকা-মেট্রো-ট-১৬-০৪০৪) গতিরোধ করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পিকেটারদের আগুনে মারাত্মক দগ্ধ হন ট্রাকচালক সামছুল। স্থানীয় এলাকাবাসী চালককে উদ্ধার করে শেরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়। পরে তাকে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে রাতেই ঢাকায় পাঠানো হয়। বগুড়ার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গাজীউর রহমান জানান, শেরপুরে ট্রাকে আগুন এবং বগুড়া শহরে পিকেটিঙের ঘটনাসহ জামায়াত-শিবিরের ১৪ জন নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। এরমধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

জেলার চৌদ্দগ্রামে হরতালের নৃশংসতার শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন ট্রাকচালক সিকান্দার। তিনি শরিয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার উত্তর কেবলনগর গ্রামের মৃত ইয়াছিন মিয়ার পুত্র। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আমজাদের বাজার মাদরাসা এলাকায় জামায়াত-শিবিরের সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীরা অতর্কিতভাবে ঢাকাগামী একটি মালবাহী ট্রাকে (ঢাকা মেট্রো-ট-১১-১৬৫৯) পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা চালকসহ ট্রাকটিকে গ্রাস করে। এতে ট্রাক চালক অগ্নিদগ্ধ হন এবং ট্রাকটি পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এদিকে আগের দিন লাকসামে পুলিশের ওপর হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের ২৪ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামাসহ ২৭৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত বুধবার রাতে পুলিশ বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করে।

জেলার প্রধান প্রধান সড়কে গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ, ককটেল বিস্ফোরণ, টায়ার জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ ও ট্রাক ভাঙচুর করেছে হরতাল সমর্থকরা। হরতালের আগের দিন শহরের অদূরে কদমতলা এলাকায় সরকারি কাজে বাধা দান, সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুরসহ নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগে জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি নূরুল হুদাসহ ১৫০ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। এ মামলায় সাত জামায়াত-শিবিরকর্মীকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

এদিকে জয়পুরহাটের কালাইয়ে আওয়ামী লীগ হরতাল বিরোধীমিছিল বের করলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জামায়াত কর্মীদের বহনকরা ভটভটিতে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৱ্যাব লাঠিচার্জ করে। পরশুরাম সংবাদদাতা জানান, বুধবার রাতে হরতাল সমর্থকরা শহরের ট্রাংক রোডে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাত ৯টার দিকে ফেনী-ছাগলনাইয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের কম্পিউটার ইনস্টিটিউটের সামনে হরতাল সমর্থকরা কয়েকটি সিএনজি অটোরিকশাতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ভাংচুর করে। এ সময় আবদুল মান্নান ও এনায়েত উল্লাহ বাবুসহ ৫ যাত্রী আহত হন। আহতদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় আবদুল মান্নান ও এনায়েত উল্লাহ বাবুকে ফেনী জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে গভীররাতে তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়।

জামায়াত-শিবিরকর্মীরা ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়কের সেনবাগ উপজেলার সেবারহাট ও ছমিরমুন্সির হাট বাজারে মালবাহী ট্রাক-পিকআপ ও মোটরসাইকেলসহ অন্তত ৮/১০টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। উপজেলার বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের বিশ্বাসবাড়ি এলাকায় বুধবার রাত পৌঁনে নয়টার দিকে দুইটি মালবাহী ট্রাক ভাংচুর করেছে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এ ঘটনায় সম্পৃক্ততা সন্দেহে ঘটনাস্থল থেকে ৩ জনকে আটক করেছে পুলিশ। বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, জেলায় পিকেটিং ও বাস ভাংচুরের সময় পুলিশ ৭ শিবিরকর্মীকে আটক করেছে। সকালে তাদের বাগেরহাট- খুলনা মহাসড়কের দশানী ও খানকাশরীফ এলাকা থেকে আটক করা হয়। চৌমুহনী (নোয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, বুধবার রাতে বেগমগঞ্জ উপজেলার বাংলাবাজারে শিবিরের একটি গ্রুপ হরতালের সমর্থনে পিকেটিং করার সময় পুলিশ তিনজনকে আটক করে। পরে তাদের নিকট থেকে একটি এলজি ও দুটি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়। এ ব্যাপারে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় মামলা হয়েছে। ভোর থেকে শহরের মালদহপট্টি, সরকারি কলেজ মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে টায়ার জ্বালিয়ে হরতালকারীরা পিকেটিং করে। এ সময় জামায়াত-শিবিরের ৬ কর্মীকে আটক করা হয়। দুপুরে আদালতের মাধ্যমে তাদের জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী মির্জাপুরে গতকাল বিকালে ছাত্রশিবিরের হামলায় ৩ ছাত্রলীগ কর্মীসহ চারজন গুরুতর আহত হয়েছে। তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরা হলো ছাত্রলীগ কর্মী প্রসেনজিত্, নাহিদ ও সাদ্দাম এবং ছাত্রদল কর্মী মেহেদী হাসান। সাদ্দামের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে। স্থানীয় মির্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা প্রসেনজিত্ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র এবং সাদ্দাম নিউ ডিগ্রি কলেজের ও নাহিদ বিনোদপুরের ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজের ছাত্র বলে জানা গেছে। এছাড়া ছাত্রদল কর্মী মেহেদী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। এদিকে ছাত্রশিবিরের হামলাকারীদের গ্রেফতারে পুলিশ এলাকার বিভিন্ন বাসা ও ছাত্রাবাসে তল্লাশি অভিযান চালায়। তবে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

গতকাল দুপুরে বরিশাল পৌর শহরের ৫নং ওয়ার্ডের চৌমাথায় হরতালের সমর্থনে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা গাছের গুঁড়ি ফেলে ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়কে অবরোধ সৃষ্টি ও ওই স্থান থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন পাইলটের সামনের দক্ষিণ পাশের সড়ক অতিক্রমকালে ওসির নেতৃত্বে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালালে ওসি গোলাম ছরোয়ার, এসআই মোতালেব হোসেন ও এএসআই আব্দুল হাই গুরুতর আহত হন।