জাপার মূল চালকের ভূমিকায় রওশন

স্টাফ রিপোর্টার: এইচএম এরশাদ জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান থাকলেও দলটিতে এখন মূল চালকের ভূমিকায় বেগম রওশন এরশাদ। দলের প্রায় সব ধরনের নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনিই (রওশন)। দলের ৩৪ জন সংসদ সদস্যের দু একজন ছাড়া অন্য সবাই চলছেন তার নির্দেশ-পরামর্শে। এরশাদ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও তাতে সায় দিচ্ছেন না এমপিরা। বরং এরশাদের কথা শুনে যারা নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন তারাও এখন তার ওপর ক্ষুব্ধ। সবকিছু মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এরশাদ বিবৃতি দেয়ার পর একান্ত অনুগতরাও এখন তার কাছ থেকে দূরে থাকছেন। তাদের বেশিরভাগ এখন রওশনসহ দলের মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে জাপায় কার্যতঃ একঘরে হয়ে পড়েছেন এরশাদ।

সর্বশেষ সংসদের সংরক্ষিত আসনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া নিয়েও সুবিধা করতে পারছেন না এরশাদ। এরশাদ যখন এককভাবেই মনোনয়ন দেয়ার উদ্যোগ নেন, তখনই তাতে সমর্থন না দেয়ার কথা জানিয়ে দেন রওশনসহ এমপিরা। এরশাদকে এমন বার্তাও দেয়া হয়, বাড়াবাড়ি করলে দলের এমপিরা সরাসরি ভোটাভুটির মাধ্যমে নারী এমপি মনোনয়ন করা হবে বলেও জানিয়ে দেন। এরপরেও এরশাদ পাঁচ হাজার টাকা করে ৯৪ জনের কাছে মনোনয়নপত্র বিক্রি করেন। তাদের সাক্ষাত্কারও নেন। একটি তালিকাও তৈরি করেন। সেটি বাহকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন রওশনের কাছে। রওশন পছন্দ না করায় এ পর্যন্ত কয়েকবার সেই তালিকায় পরিবর্তন এনেছেন তিনি। এভাবে চলার পর উভয়ের মধ্য সমঝোতা হয় যে, উভয়ের পছন্দে তিনজন করে ছয়জন মনোনীত করা হবে। কিন্তু সেই সমঝোতাও এখন ভেস্তে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে রওশনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত জাপার এমপি তাজুল ইসলাম চৌধুরী গতকাল ইত্তেফাককে জানান, এরশাদ যাদের নাম প্রস্তাব করে তালিকা পাঠাচ্ছেন-তাদের বেশিরভাগই দলের কেউ নন। তাদেরকে দলের নেতা-কর্মীরাও চেনেন না। কিন্তু রওশনসহ এমপিরা চাচ্ছেন, যারা সত্যিকারের দলীয় নেত্রী বা কর্মী, কিংবা দলের জন্য কাজ করেছেন, তারা যেন সংসদে যেতে পারেন। মূলত এই কারণেই তালিকা চূড়ান্ত করতে সময় লাগছে।

তাজুল ইসলাম আরও জানান, সরাসরি দেখা না হলেও এরশাদের সঙ্গে রওশনের নিয়মিত টেলিফোনে আলাপ হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দুইজনের যৌথ পছন্দেই সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। তবে দলের বাইরের কাউকে এমপি না করার ক্ষেত্রে এমপিরা অনড় থাকবেন।

জানা গেছে, রওশনসহ জাপার এমপিরা সংরক্ষিত আসনের জন্য এরইমধ্যে একটি প্রাথমিক তালিকা ঠিক করেছেন। তাতে নূর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী, মাহ্যাবীন মোরশেদ, অধ্যাপিকা রওশন আরা মান্নান, খুরশিদা হক ও শাহানারা বেগমের নাম রয়েছে। লিলি চৌধুরী ও মাহবীন নবম সংসদেও সংরক্ষিত আসনে জাপার এমপি ছিলেন। রওশন আরা মান্নান এর আগে সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন। কক্সবাজারের খুরশিদা ও রংপুরের শাহানারা দুইজনই দীর্ঘদিন জাপার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

সূত্রমতে, এ তালিকা এরশাদের কাছে পাঠানো হলে তিনি লিলি চৌধুরী ও মাহ্যাবীন মোরশেদের নাম রেখে বাকি চারটিতে নিজের পছন্দের চারজনকে রাখার কথা বলেছেন। ওই চারজনের মধ্যে তিনি শেরিফা কাদের, মেরিনা রহমান, কণিকা রায় ও মাহমুদা চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেন। এদের মধ্যে শেরিফা কাদের এরশাদের ভাই জিএম কাদেরের স্ত্রী। মেরিনা রহমান এরশাদের ছোট বোন। কণিকা রায় হচ্ছেন এরশাদের প্রেস এ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায়ের পত্নী। তবে রওশন এই তালিকা নাকচ করে দেয়ায় এরশাদ নতুন তালিকা দেন। সেখানে তিনি সানজিদা নাহিন ও মাহমুদা নামের দুই ধনাঢ্য মহিলার নাম প্রস্তাব করেন। এরশাদ তালিকায় একজন পীরের কন্যার নাম অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন। এজন্য আগের তারিখ দিয়ে এরশাদ ওই পীরকন্যাকে সম্প্রতি দলেও যোগদান করিয়েছেন। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলা জাপার সভাপতি মৌসুমীর (যিনি নিজেকে এরশাদের পালিত কন্যা বলে দাবি করেন) নামও অন্তর্ভুক্ত করতে চান এরশাদ। তবে তাদের বিষয়ে রওশনসহ দলের প্রায় সকল এমপি আপত্তি দিয়েছেন।

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি বলেন ‘যারা দীর্ঘদিন দলের সুখে-দুঃখে সঙ্গে ছিলেন, আমরা চাই তারাই যেন সংসদে যান। টাকা-পয়সা বা অন্যকিছুর বিনিময়ে কেউ জাপার হয়ে সংসদে যাক, এটা আমাদের কাম্য নয়। সেক্ষেত্রে রওশন এরশাদ যাদের নাম মোটামুটি ঠিক করে রেখেছেন তারা প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন ধরে দলের রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত।

এদিকে টানা এক মাস ঢাকা সেনানিবাসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিত্সাধীন থাকার সময় যারা এরশাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তারাও এখন এক এক করে এরশাদের সঙ্গ ছাড়ছেন। এরশাদের নির্দেশ মেনে যারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছিলেন, তাদের কেউ রওশনের সঙ্গে ভিড়তে চেষ্টা করছেন, কেউ-কেউ হতাশ হয়ে জাপার রাজনীতিই ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ক্ষোভে-দুঃখে রাজনীতিতে নিজেকে নিষ্ক্রিয় করে নিয়েছেন।

এরকম কয়েকজন বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচন ‘বর্জনের’ ঘোষণা দিয়েও চুপিসারে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ, সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসার পাশাপাশি মন্ত্রিসভায়ও জাপার ভাগ বসানো এবং সর্বশেষ পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হওয়া- সবকিছুই এরশাদ কবুল করে নিয়েছেন। বিশেষ দূত করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বৃহস্পতিবার তিনি যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেখানেই তিনি কার্যত সবকিছু মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে এরশাদ আসলে নিজের দলের নেতা-কর্মীদেরই ঠকিয়েছেন।

সিএমএইচে চিকিত্সাধীন থাকাবস্থায় এরশাদের পক্ষে অবস্থান নেয়া এবং তার নির্দেশে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা জাপার প্রেসিডিয়ামের এক সদস্য বলেন, এখন কী দেখলাম! এরশাদ এমপি ও মন্ত্রীর মর্যাদায় বিশেষ দূত, তার স্ত্রী রওশন মন্ত্রীর মর্যাদায় বিরোধী দলের নেতা, দলের মহাসচিব ও তার স্ত্রী দুজনই এমপি, যারা এরশাদের কথা উপেক্ষা করে নির্বাচনে ছিলেন তাদের অনেকেই এখন এমপি। আমরা কী পেলাম! এরশাদের কথা শুনে তো আমরাই এখন দুই কূল হারালাম। আমাদের এই ক্ষতি তো এরশাদই করেছেন।

দলের এরকম আরেক নেতা বলেন, অন্য দলের নেতারা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাজনীতি করেন। অথচ এরশাদ রাজনীতি করলেন নিজ দলের নেতাকর্মীদের সাথে। তিনি কেনই বা নির্বাচনে এলেন, কেনই বা আবার সরে গেলেন, এরপর এখন কেন সবকিছু কবুল করছেন- কোনো কিছুরই জবাব আমাদের কাছে নেই। এরশাদ যদি নির্বাচন নিয়ে এই তামাশা না করতেন তাহলে নির্বাচনটিও এতো বিতর্কিত হয় না, এমনকি জাপার অন্তত ৭০ জন এমপি হয়ে এখন সংসদে থাকতেন।

এ ক্ষোভের বিষয়ে জাপার মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, একটি বড় দলে কিছু ভুল বোঝাবুঝি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ক্ষোভ-হতাশা থাকতেই পারে। তবে দিনের শেষে আমরা সবাই জাপা করি। আমরা সবাই এক ও ঐক্যবদ্ধ আছি। যারা এখন ক্ষতিগ্রস্ত বলে মনে করছেন, একসময় নিশ্চয়ই তারাও মূল্যায়িত হবেন। সবাইকে নিয়েই আমরা চলতে চাই।