ছেলেরা মাকে না দেখলে কি হবে আমি তো আর তাকে ফেলে দিতে পারি না।

 মহাসিন আলী: মায়ের চিকিৎসার ভার ৫ ছেলে না নিলেও অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ৭৯ বছর বয়সেও খড়ের বাড়ুন পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন বৃদ্ধ সলেমান মণ্ডল। এরপরও স্বামীর ভাত বঞ্চিত মেয়ে ও মেয়ের ২ সন্তান চেপে বসেছে বৃদ্ধের ঘাড়ে। মানবতাবিরোধী ঘটনাটি ঘটে চলেছে মেহেরপুর জেলা শহরের উপকণ্ঠ দীঘিরপাড়া গ্রামের বেলেগাড়িপাড়ায়।
মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের দীঘিরপাড়া গ্রামের বেলেগাড়িপাড়ার মৃত আহমেদ আলী ম-লের ছেলে সলেমান ম-ল। পেশায় তিনি ছিলেন একজন কৃষক। তার নিজের জমি ছিলো না। তাই অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষ করতেন। সংসার জীবনে তার রয়েছে স্ত্রী এবং ৫ ছেলে ও ৫ মেয়ে। তার স্ত্রী রিজিয়া খাতুন (৬৯) পঙ্গু। তার ওপর চেপে বসেছে স্বামীর ভাত বঞ্চিত এক মেয়ে। মেয়ের সাথে আছে তার ২ ছেলে-মেয়ে। কৃষিকাজের মতো কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করা বর্তমানে সলেমানের শরীরে সহ হয় না। তাই তিনি চাষবাস ছেড়ে দিয়েছেন। যে বয়সে বসে বসে তার ৫ ছেলের ভাত খাওয়ার কথা। আর নাতি-পুতিদের নিয়ে আনন্দ করার কথা। সেই বয়সে সুখ তার কপালে জোটেনি। নিজের জন্য নয়; অসুস্থ স্ত্রী রিজিয়া খাতুনের চিকিৎসার জন্য বিগত ১০ বছর ধরে ভ্যানে করে নিজের হাতে তৈরি খড়ের বাড়ুন নিয়ে শহর ও গ্রামের পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন বৃদ্ধ সলেমান মণ্ডল। প্রতিটি বাড়ুনে তার লাভ আসে দেড় টাকা থেকে ২ টাকা।
চাপা ক্ষোভ আর এক বুক দুঃখ নিয়ে সলেমান ম-ল বললেন, কপালে সুখ তার ধরা দেয়নি। বয়সকালে ৫ ছেলে ও ৫ মেয়ে মানুষ করতে অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করেছি। তাদের বড় করেছি। মনে হয়েছিলো ছেলেরা বড় হলে শেষ বয়সে বসে থেকে আমরা বুড়া-বুড়ি দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খাবো। সে সুখ কপালে সইলো না তাদের। স্ত্রী রিজিয়া খাতুন অসুস্থ। প্রায় ১৫ বছর ধরে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে। ছেলেরা মাকে চিকিৎসা করে না। খেতে দেয় না। ছোটবেলায় যাকে জীবনসঙ্গী করে ঘরে নিয়ে এসেছি। তাকে তো আর ফেলে দেয়া যায় না। ছেলেরা মাকে না দেখলে কি হবে? আমি তো আর তাকে ফেলে দিতে পারি না। এরপরও এক জামাই তার ২ সন্তানসহ আমার মেয়েকে আমার ঘাড়ে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে। সে আর ফিরে আসে না। তাদের খোঁজ-খবরও রাখে না। এই বৃদ্ধ বয়সে শরীর চলে না। তার পরও সকলের মুখের দিকে চেয়ে আমি এ কাজটি বেছে নিয়েছি।
এক প্রশ্নের জবারে তিনি আরও বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগে গ্রামের মেম্বার বয়স্কভাতার একখানা কার্ড করে দিয়েছে। প্রতি ৬ মাস অন্তর একবার ইউনিয়ন পরিষদ গিয়ে ৩ হাজার টাকা করে পাই। তার স্ত্রী পায় না বয়স্কভাতা। অসুস্থ স্ত্রীর ওষুধ কেনাসহ ৫ জনের সংসার চালানো খুবই কষ্টের। তাই গ্রাম থেকে খড় কিনে রোদে শুকিয়ে এবং দড়ি ও কাটি কিনে নিজের হাতে বাড়ুন বানাই। অনেক কষ্টে কেনা ভ্যান চালিয়ে একদিন বাদে একদিন শহর ও জেলার বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জের পাড়া মহল্লায় গিয়ে বাড়ুন বিক্রি করি। প্রতিদিন দেড়শ’ থেকে ২শ’ বাড়–ন বিক্রি হয়। তাতে যে লাভ আসে তাতে কোনোভাবে খেয়ে না খেয়ে দিন চালাতে হয়। একই গ্রামের অনেকে জানান, তার ছেলেরা পৃথক এবং তারা কেউ বৃদ্ধ বয়সের মা-বাবাকে দেখে না। অনেক কষ্টে তারা জীবন যাপন করছেন।
আমঝুপি ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড সদস্য আনারুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগে আমি সলেমান ম-লকে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দিয়েছি। তার স্ত্রী অসুস্থ শুনেছি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি তাকে বয়স্ক ভাতার একটি কার্ড করে দিতে পারিনি। সুযোগ হলে অসুস্থ মানুষটি জন্য আমি একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেবো।
বৃদ্ধ সলেমান ম-ল আক্ষেপ করে বললেন, তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য যদি কোনো সরকারি-বেসরকারি কিংবা দাতা সংস্থা এগিয়ে আসতেন, তবে তিনি কৃতজ্ঞতা ভরে তাদেন দান গ্রহণ করবেন।