চুয়াডাঙ্গার পাট চাষিরা চরম হতাশায় : স্বপ্নের সোনালী আঁশ এখন গলার ফাঁস

সরকার প্রত্যাশিত মূল্যে পাঠ কেনার ঘোষণা দিলেও তার সুফল পাচ্ছেন না কৃষককূল

নজরুল ইসলাম: চুয়াডাঙ্গা জেলার পাট চাষিরা পাট চাষ করে দাম না পেয়ে চরম হতাশায় পড়েছেন। বাংলার সোনালী আঁশখ্যাত পাট এখন যেনো কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে দাড়িয়েছে। এক সময় সোনালী আঁশ পাট বিক্রি করে সন্তানের জন্য চক সিলেট কিনতেন অনেক কৃষক। স্বপ্ন নিয়ে পাটচাষ করে কাঙ্খিত মূল্য না পেয়ে স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে দাড়িয়েছে কৃষকের কাছে। লোকশান হবার আশঙ্কায় বর্তমানে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পাট কেনা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন। তাই কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত পাট অযত্নে অবহেলায় যেখানে সেখানে ফেলে রেখেছে। পাট না কৃষকের এখন ভরাসা পাটকাটিতে। পাটের চাইতে পাটকাটিকে যত্ন করে সংরক্ষণ করছেন। পাটকাটি পাওয়ার আশায় জন খোরচ করে হলেও পচনকৃত পাট থেকে আঁশ ছাড়াচ্ছেন। অন্যান্য আবাদের লোকশান পুষিয়ে নিতে এ বছর চাষিরা বিপুল উৎসাহ নিয়ে অতিরিক্ত পাট চাষ করেছেন। জেলাতে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চাইতে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ বেশি হয়েছে। অপরদিকে সরকারিভাবে জেলাতে কোনো পাট ক্রয় কেন্দ্র না থাকায় পাটের বাজারের এ দূরাবস্তার কোনো উত্তর নেই কারো কাছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন চাষিরা পাটচাষ থেকে সম্পূর্ণরুপে মুখ ফিরিয়ে নেবে এমনটায় মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।
সোনালি আঁশ পাট বাংলার ঐতিহ্য। অর্থকারী ফসল হিসেবে পাট বাংলার মানুষের জীবনমানে যতোটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে অন্যকোনো ফসলের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। তাই পাট বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকারী ফসল। আমাদের দেশের ভূমি এবং জলবায়ু পাটচাষের জন্য খুবই উপযোগী। বিশ্বের সবচাইতে উন্নতমানের পাটচাষ হয়ে থাকে এদেশে। পাট আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অথচ নানাভাবে পাট ও পাট শিল্পকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদফতরের সূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলার মোট আয়তন ১ লাখ ১৪ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫৭ হাজার ৫৮২ হেক্টর । আবাদযোগ্য জমির মধ্যে চলতি বছর পাটচাষ হয়েছে ২২ হাজার ৭০ হেক্টর। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলাতে ২ হাজার ৬৫০ হেক্টর, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৯ হাজার ২৮০ হেক্টর, জীবননগর উপজেলায় ২ হাজার ২৫০ হেক্টর এবং দামুড়হুদা উপজেলায় ৭ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে। পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১৮ হাজার ১৫০ হেক্টর জমি। সর্বমোট আবাদ হয়েছে ২২ হাজার ৭০ হেক্টর জমি। লক্ষমাত্রার চেয়ে পাট চাষ বেশি হয়েছে ৩ হাজার ৯২০ হেক্টর জমি। পাট উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছিলো ৪৭ হাজার ১৯০ মেট্রিক টন। সেখানে পাট উৎপাদন হয়েছে ৫৭ হাজার ৩৮২ মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রার চাইতে উৎপাদন বেশি হয়েছে ১০ হাজার ১৯২ মেট্রিক টন। হেক্টর প্রতি ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ২ দশমিক ৬ মেট্রিক টন। গত বছর পাটের বাজার দর ছিলো ১ হাজার ৪শ থেকে দেড় হাজার টাকা মন। এ বছর শুরুতে ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ৪শ টাকা মন কেনা হলেও বর্তমানে চকচকে জকঝকে পাট ১ হাজার ১শ থেকে ১ হাজার ২শ টাকা মন কিনছে ব্যবসায়ীরা। একটু গায়ের রঙ মন্দ হলে সে পাট কেনার খরিদারই জুটছে না। বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে পাট কিনে গত বছর লোকশান হওয়ায় স্থানীয় আড়তদাররা পাট কেনা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। পাটের বাজার পড়ে যাওয়ায় পাট চাষিরা হতাশ হয়ে পড়েছে। কারণ পাট বিক্রি করে পাটকাটা জমিতে নতুন করে চাষ এবং অন্যান্য ফসল আবাদ করবে। বর্তমান মূল্যে পাট বিক্রি করলে পাটচাষিদের লাভ তো দূরের কথা প্রতি বিঘা জমিতে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা লোকশান গুণতে হচ্ছে।
পাটচাষি আকন্দবাড়িয়ার জাহাঙ্গীর এবং শৈলমারী গ্রামের ওয়াসিম পাটচাষের কথা জিজ্ঞাসা করতেই রেগে গিয়ে বললেন, যদি কৃষিবিভাগ বা সংস্থার লোকহন তাহলে এখান থেকে চলে যান। চাষিরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করবে আর মহাজনরা আমাদের রক্তচুষে খাবে। তাদের বিষয়ে কেউ কিছু করে না শুধু চাষিদের কাছে শান্তনার বাণি। চাষি সিরাজুল আমিরুল, শফিকুল, আরমান, জামিরুল, কিতাব আলী, জালাল উদ্দীন বলেন, এক বিঘা জমি পাটচাষ করতে চাষ, সেচ, নিড়ানি, সার, কাটা, বহন করা, জাগ দেয়া, ধোয়া, শুকানো ও সর্বশেষ গাড়ি ভাড়া করে বাজারে নিয়ে বিক্রি করা পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। যদি জমি লিজের হয় তাহলে খরচ আরও বাড়বে। লোকশানের পাল্লাও ভারি হবে। এক বিঘা জমিতে গড়ে পাট হচ্ছে ৮ থেকে ১০ মন। বাজার দর হিসেবে বিক্রি করলে এক বিঘা পাটের মূল্য দাড়াবে ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা। ফলে বিঘা প্রতি লোকশান ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে পাটকাটি হয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। তাই তো পাটে আমাদের ভরসা নেই ভরসা পাটকাটিতে। এদিকে গত বছর যেসব চাষি পাট বিক্রি না করে ঘরে রেখে ছিলেন সে পাট বাজারে বেচা বিক্রি নেই। বর্তমানে পাটের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে ফঁড়িয়া ও ব্যবসায়ীরা। তাদের ইচ্ছেমতো পাট কিনছে। এক এক জায়গায় এক এক দাম। বাজারে কোনো নিয়ম-কানুন নেই। যে যার ইচ্ছোমতো পাট কিনছে বিক্রি করছে। পাটের মূল্য নিয়ে এমন টালবাহানা থাকলে আগামীতে জেলাতে পাটের আবাদে ধস নামবে এমনটায় জানালেন পাট চাষিরা। পাটচাষ করে চাষিরা কাঙ্কিত দাম পাচ্ছে না কয়েক বছর ধরে। তাই পাটচাষ এবং উৎপাদন বাঁচিয়ে রাখতে হলে চাষিদের স্বার্থকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হবে। চাষিদের স্বার্থকে উপক্ষো করে পাটচাষ ধরে রাখা সম্ভব না। তাইতো পাটচাষিদের উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। জেলাতে ন্যায্যমূল্যে সরকারিভাবে পাট কেনার কোনো বন্দবস্ত নেই। জেলাতে পাট ক্রয়কেন্দ্র থাকা অতিব জরুরি হয়ে পড়েছে।
পাট ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান, মওলা বিশ্বাস, উজ্জলসহ অনেকেই জানালেন, পাটের বাজারে কখন কি ঘটে বলা মুশকিল। লোকশান জেনেতো আর পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারি না। মনের মধ্যে শঙ্কা থাকায় পাট কিনতে সাহস পাচ্ছিনা। কারণ গত বছর পাট কিনে ধরা খেয়েছি। লোকশান দিয়ে কিছু পাট বিক্রি করলেও এখনও কম বেশি পাট ঘরে আছে।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা মুখ্য পাট পরিদর্শক আলাউদ্দীন বলেন, বিভিন্ন কারণে পাটের ফলন যেমন কম সেই সাথে মূল্যও কম। পাটের যে ফলন এবং দাম তাতে করে প্রত্যেক পাট চাষির কম বেশি লোকসান গুণতে হবে। এভাবে প্রতিবছর আশা নিয়ে পাটচাষ করে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্থ হলে একদিন হয়তো চাষিরা আর পাট চাষই করবে না। তিনি জানালেন, পাশ্ববর্তী জেলা মেহেরপুরে সরকারিভাবে একটি পাট ক্রয় কেন্দ্র থাকলেও এ জেলাতে নেই। যদি থাকত তাহলে চাষিরা উপকৃত হতো।