খালেদা জিয়ার জামিন ৮ মে পর্যন্ত স্থগিত

স্টাফ রিপোর্টার: জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন আদেশ আগামী ৮ মে পর্যন্ত স্থগিত থাকছে। একই সঙ্গে তার জামিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের অনুমতি পেয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ এই আদেশ দেন। পক্ষগুলোকে আপিলের সংক্ষিপ্ত সার জমা দিতে সময় বেঁধে দিয়ে আদালত আগামী ৮ মে আপিল শুনানির জন্য দিন রেখেছে।

আইনজীবীরা বলছেন, এই মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত হওয়ায় এবং আরও কিছু মামলায় তার জামিন নেয়ার প্রয়োজন থাকায় তিনি এখনই কারাগার থেকে বের হতে পারছেন না। খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে পক্ষগুলোর করা পৃথক আবেদনের ওপর গত রোববার শুনানি শেষ হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ সোমবার আদেশের জন্য দিন রেখেছিলেন।

ওই মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থ দণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেয় বিচারিক আদালত। এরপর থেকে খালেদা জিয়া নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। রায়ের পর আপিল করে জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন খালেদা জিয়া, যার ওপর শুনানি নিয়ে ১২ মার্চ হাইকোর্ট চারটি দিক বিবেচনায় তাকে চার মাসের জামিন দেয়।

এই জামিন স্থগিত চেয়ে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক আবেদন করে। শুনানি নিয়ে ১৪ মার্চ আপিল বিভাগ ওই জামিন গত রোববার পর্যন্ত স্থগিত করে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে এই সময়ের মধ্যে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলে। অন্যদিকে, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা, যা সেদিন চেম্বার বিচারপতির আদালতে ওঠে। আদালত আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠায়। পরে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে। এসব আবেদন রোববার শুনানির জন্য ওঠে।

শুনানিতে খুরশীদ আলম খান বলেন, আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত আছে, স্বল্পমেয়াদে সাজা হলে দ্রুত আপিল শুনানি করতে হবে। এই নজির তুলে ধরা হলেও হাইকোর্টের আদেশের প্রতিফলন হয়নি, যা আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। হাইকোর্টের আদেশে এসেছে, উনি (খালেদা জিয়া) জামিনে ছিলেন। কিন্তু তিনি জামিনের অপব্যবহার করেছেন কিনা, সেটা দেখার বিষয়। বিচারিক আদালতের অনুমতি না নিয়ে এবং অবহিত না করেই চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যান, বিচারিক আদালতের আদেশনামায় এর বিস্তারিত এসেছে। এর থেকে বড় অপব্যবহার কী হতে পারে? আদালতের অনুমতি ছাড়া বিদেশ যাওয়ার চেয়ে বড় অডাসিটি কী হতে পারে?

স্বাস্থ্যগত দিকের যুক্তির বিষয়ে খুরশীদ আলম খান বলেন, এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা-সংক্রান্ত কাগজ বা সনদও দেয়া হয়নি। বয়স্ক ও নারী বিবেচনায় বিচারিক আদালত পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছে। একই কারণে দুইবার সুবিধা পেতে পারেন না।

ধারাবাহিক ঘটনা তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বিচার বিলম্বিত করতে তারা (খালেদাপক্ষ) এমন কোনো পন্থা নেই যে, নেয়নি। এখানে পাঁচ বছর সাজা হয়েছে, পাঁচ বছরেও আপিল শুনানি হবে না, এটা অযৌক্তিক। তিনি বলেন, একজন আসামিকে কতোবার সুবিধা দেয়া হবে? খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কথা বলা হচ্ছে, অথচ তিনি মিটিং করেছেন, সমাবেশ করেছেন এবং বিদেশ যাচ্ছেন। যদি জামিন দেয়া হয়, তাহলে আপিল শুনানি অনিশ্চিত হয়ে যাবে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘হাইকোর্ট পেপারবুক তৈরি করতে চার মাস সময় দিয়েছে, কমিয়ে দুই মাস করে দেয়।’ বিভিন্ন নজির তুলে ধরে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় হাইকোর্ট জামিন দিতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদের সাজায় জামিন হয়েছে। ৪২৬ ধারার বিধান অনুসারে কারণ উলেস্নখ করে হাইকোর্ট জামিন দিতে পারে। এই মামলায় হাইকোর্ট কারণ উল্লেখ করে জামিন দিয়েছে। খুব ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে পারে, যদি হাইকোর্টের আদেশ ন্যায়ভ্রষ্ট হয়। তিনি বলেন, ৪৯৭ ধারায় আছে, নারী ও শিশুকে জামিন দেয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে ৪২৬ ধারা একই। এটি ধারাবাহিকতা। এই আইনজীবী বলেন, স্বল্পমেয়াদে সাজা একটি দিক, আরেকটি দিক হলো আপিল। আপিলে যদি সাজা না থাকে বা কমে যায়, তখন কী হবে? এ ক্ষেত্রে ভারসাম্যের ওপর জোর দিতে হবে।

খালেদার অপর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মামলা বলে এর গুরুত্ব। তিনি না হলে আমরাও আসতাম না, সরকারও এত উৎসাহী হতো না। হাইকোর্টের এখতিয়ার আছে জামিন দেয়ার।’

এ আদেশ নজিরবিহীন: জামিন প্রশ্নে সর্বোচ্চ আদালতের এই আদেশকে ‘নজিরবিহীন’ ও ‘অপ্রত্যাশিত’ হিসেবে বর্ণনা করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। মওদুদ আহমদ বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত আদেশ দিয়ে দিয়েছে, এখন আইনি লড়াই ছাড়া বিকল্প নেই। আরেকটি হচ্ছে রাজপথের আন্দোলন। সেটি তো সুপ্রিম কোর্টে করতে পারবৌ না। তবে আমরা যারা আইনজীবী আছি, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তার (খালেদা জিয়া) কারামুক্তির জন্য।’ এছাড়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন আদালত থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই আদেশকে আমরা ‘নজিরবিহীন’ বলতে বাধ্য হচ্ছি এ কারণে যে, অতীতে এ ধরনের আদেশ দেশের সর্বোচ্চ আদালত দেয়নি।’ তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দেশের নিম্ন আদালতগুলোকে ‘গ্রাস করে’ ফেলেছে।

‘উচ্চ আদালতকেও মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে গ্রাস করার চেষ্টা করছে। আদালতকে এ জন্য আমি বলেছি, দেশের মানুষ আপনাদের কাছে বিচার পাওয়ার আশা নিয়ে আসে। কিন্তু তারা আশাহত হলে এই বিচারপ্রার্থী মানুষের আস্থা থাকবে না। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমরা মর্মাহত। আমরা ব্যথিত।’

শুনানি: সকালে আদেশের শুরুতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘এটা কিন্তু আমাদের সবার ডিসিশন। সর্বসম্মতিক্রমে এই আদেশ দিচ্ছি।’ আদেশের পর আপিল বিভাগ নিয়মিত কার্যক্রমে যায়। কিছু সময় পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘আমি দুঃখিত। আপনি কী আদেশ দিয়েছেন, সেটা বুঝতে পারিনি।’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা সর্বসম্মত হয়ে এই আদেশ দিয়েছি।’ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমি এটা জানতে চাইনি। কোন যুক্তিতে লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করেছেন, সেটা জানতে চাই।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা নথি পর্যালোচনা করেছি।’ তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরাতো মেরিটে (মামলার মূল বিষয়বস্তুতে শুনানি করিনি) বলিনি।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপিলে বলতে পারবেন।’ এরপর খালেদা জিয়ার এই আইনজীবী বলেন, ‘আপনারা সর্বোচ্চ আদালত। আপনারা যে আদেশ দেবেন শিরোধার্য। তবে ২২ মে অনেক দূর। আজকে যেভাবে লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করলেন, এটা নজিরবিহীন। অতীতে এ ধরনের ক্ষেত্রে কোনো দিন লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করা হয়নি। তাহলে তো সব (অতীতের সব মামলায়) লিভই (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করা উচিৎ ছিলো।’ তখন প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ অফিসারকে ডেকে চার সপ্তাহের জায়গায় দুই সপ্তাহ করে দিতে নির্দেশ দেন।

এ পর্যায়ে জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘ঠিক আছে। আপনি দুই সপ্তাহ করলেন। ২২ মে তারিখের ওই সময়টা এগিয়ে আনার অনুরোধ করছি।’ এ সময় ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন আদালতকে বলেন, ‘সরকার যে উদ্দেশে এটা করেছে…। দুদক আর সরকারতো একাকার হয়ে গেছে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়।’

এরপর জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘সময়টা কমিয়ে দেন। এপ্রিলে দেন।’ তখন বিচারপতি ইমান আলী বলেন, তখন সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি থাকবে। এ পর্যায়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘ভ্যাকেশনের আগে দেন।’

বিচারপতি ইমান আলী তখন বলেন, ‘আফটার ভ্যাকেশন।’ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আফটার ভ্যাকেশন হলে দিন নির্ধারণ না করলে তো একই থাকল?’ তখন প্রধান বিচারপতি ৮ মে পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত রেখে ওইদিন আপিল শুনানির দিন নির্ধারণ করে দেন। পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজের অফিসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার এখন আর মুক্তি হবে না। তাকে কারাভোগ করতে হবে।’ খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের বক্তব্য নিশ্চয়ই খুব একটি ভালো না। জিনিসটাকে রাজনীতিকীকরণের চেষ্টা করছে।’ খালেদার আইনজীবীদের শেষ চেষ্টা খালেদা জিয়ার বিষয়ে আদেশের পর নিয়মিত কার্যক্রমের ফাঁকে বেলা ১১টায় আদালত বিরতিতে যায়। সাড়ে ১১টায় আদালত আবার বসলে আপিল শুনানি এগিয়ে আনতে আরজি জানান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।

কিন্তু শুনানির জন্য ঠিক করা ৮ মে তারিখ না বদলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এই মামলা কোনো ধরনের মূলতবি ছাড়া বিরতিহীনভাবে শুনানি করা হবে।’ বিচারকদের সামনে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী জমির উদ্দিন সরকার করজোড়ে বলেন, ‘আদালতের কাছে আমাদের বিনীত আবেদন, সবার পক্ষ থেকে করজোড়ে আবেদন করছি, খালেদা জিয়ার মামলা ভ্যাকেশনের আগেই শুনানির দিন ধার্য করা হোক।’ তখন বিচারক বলেন, ‘আমরা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ৮ মে দিন ধার্য করেছি। আমরা প্রথমে যে আদেশ দিয়েছিলাম, আপনাদের অনুরোধে তা পুনঃবিবেচনা করেছি। আদেশ হয়ে গেছে এখন আর পরিবর্তন সম্ভব নয়।’ এরপরও জমির উদ্দিন সরকার অনুরোধ জানাতে থাকলে বিচারক বলেন, ‘আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি, ৮ মে এই মামলা শুনানির জন্য তালিকায় শীর্ষে থাকবে। কোনো ধরনের মুলতবি ছাড়া বিরতিহীনভাবে শুনানি হবে। ৮ মে না হলেও ৯ মের মধ্যে এই মামলার নিষ্পত্তি করবো।’ এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আদালত কক্ষ থেকে বের হয়ে যান।