এবারের ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন : আখেরি মোনাজাতে শান্তি সমৃদ্ধি কামনা

স্টাফ রিপোর্টার: ‘হে আল্লাহ! ইজতেমার মেহনত কবুল করো। হে আল্লাহ! পুরো উম্মতের ওপর রহম করো। আমাদের অন্তরকে ইসলামের ওপর দাখিল করে দাও। হে আল্লাহ, সব মানুষকে হেদায়েত দাও, পেরেশানি দূর করে দাও। আমাদের দোয়া কবুল করো। গভীর আকুতিপূর্ণ মোনাজাতের মধ্যদিয়ে গতকাল রোববার শেষ হয়েছে তাবলীগ জামায়াত আয়োজিত ৫১তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ এ আখেরি মোনাজাতে বিশ্ব মুসলিমের শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি এবং দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি কামনা করে দুই হাত তুলে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে রহমত প্রার্থনা করেন। কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে কেঁদে বুক ভাসান। এ সময় টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে লাখ লাখ মুসলমানের কণ্ঠে আমিন! আমিন! আল্লাহুম্মা আমিন!! ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস ক্রন্দোলিত হয়ে ওঠে।
গতকাল রোববার সকাল থেকে ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশে এলাকায় ঘন কুয়াশা পড়তে দেখা যায়। কুয়াশা ও শীত উপেক্ষা করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, গাজীপুর ও টঙ্গীসহ আশপাশের জেলা থেকে বিপুলসংখ্যক মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে আখেরি মোনাজাতে শরিক হন। অনেকেই ইজতেমা ময়দানের আশেপাশের বাড়ি, বেড়িবাঁধ, যানবাহনে উঠে এবং নৌকায় বসে মোনাজাতে অংশ নেন। অনেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মোনাজাতে শরিক হন। সকাল ১১-৪ মিনিটে শুরু হয়ে ১১-৩৩ মিনিট পর্যন্ত ২৯ মিনিট স্থায়ী মোনাজাত পরিচালনা করেন তাবলীগ জামাত মারকাজের শুরা সদস্য ভারতের হযরত মাওলানা মুহাম্মদ সাদ।
রীতি অনুযায়ী আখেরি মোনাজাতের আগে হেদায়াতের সমাপনী বয়ানও করেন তিনি। এই আখেরি মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও গুনাহ্ মাফের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে অফুরন্ত রহমত প্রার্থনা করা হয়। এ আখেরি মোনাজাত চলাকালে পুরো ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশের এলাকায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। এ সময় ইজতেমা ময়দান এলাকায় সমবেত বিশাল জনসমুদ্রে এক অভূতপর্ব ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। সর্বত্র এক পূণ্যময় পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে।
ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে আখেরি মোনাজাতে লাখ লাখ মুসল্লির সাথে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম আলম, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ হারুন অর রশিদ, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ শরিক হন।
গতকাল ইজতেমাস্থলের চারপাশে প্রায় ৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিলধারণের ঠাঁই ছিলো না। আখেরি মোনাজাতের জন্য রোববার আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছুটি ছিলো। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিলো না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এবং মহিলারাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে রোববার সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছান। মোনাজাত শুরুর আগেই সকাল ১০টার মধ্যে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় তুরাগ তীরের পুরো ইজতেমাস্থল ও চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। পরিণত হয় বিশাল জনসমুদ্রে।
ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে মুসল্লির সংখ্যা প্রথম পর্বের চেয়ে কিছুটা কম ছিলো বলে ইজতেমা আয়োজক-সংশ্লিষ্টদের ধারণা। ইজতেমা সংশ্লিষ্ট মুরব্বিরা বলেন, দ্বীনের পথে নিজেকে নিয়োজিত করতে যে সকল মুসল্লি ইজতেমায় আসেন তাদের কোনো অবস্থাতেই থামিয়ে রাখা যাবে না। রোদ, বৃষ্টি, শীতসহ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগই দ্বীনের দাওয়াতি মেহমানদের আটকাতে পারে না। তারা বলেন, যারা কেবল মোনাজাতের জন্য বিভিন্নস্থান থেকে আসেন তাদের আসা-যাওয়া কম-বেশি হতে পারে। কেবল মোনাজাতে অংশ না নিয়ে দ্বীনের প্রতি সময় লাগানোর জন্য সকল মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান মুরব্বিরা।
আখেরি মোনাজাতের আগে তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বিরা হেদায়েতি ও সংক্ষিপ্ত বয়ানে বলেন, প্রত্যেক মুসলমানকে দিনের বেলায় মেহনত আর রাতের বেলায় ইবাদত-বন্দেগি করতে হবে। দুটির একটি করলে ফায়দা হবে না। মেহনত ও ইবাদতের মধ্যদিয়ে মুসলমানের মৃত্যু পর্যন্ত দ্বীনের রাস্তায় অনড় থাকতে হবে। গতকাল আখেরি মোনাজাতের আগে হেদায়েতি বয়ান করেন হযরত মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ। বয়ানের বাংলা তরজমা করেন ঢাকার কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা যোবায়ের। বয়ানে বলেন, যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলামের বিধান অনুসারে চলবে এবং হযরত মোহাম্মদের (সা.) জীবনাদর্শ অনুসরণ করবে, সে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি অর্জন করবে। বয়ানে বলা হয়, নামাজের আগে আমাদের দিলে একিন বা ঈমান পয়দা করতে হবে। তা না হলে নামাজের ফজিলত পাওয়া যাবে না।
টেলিভিশন-মোবাইলফোন ও ওয়্যারলেসে মোনাজাত: ইজতেমা মাঠে না এসেও মোনাজাতের সময় হাত তুলেছেন অসংখ্য মানুষ। গাজীপুরে ও আশেপাশ এলাকার ধর্মপ্রাণ নারী-পুরুষ যারা ময়দানে এসে মোনাজাতে অংশ নিতে পারেননি তারা টেলিভিশন সেটের সামনে বসে ও মোবাইলফোনে মোনাজাতে অংশ নেন।
মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যা: রোববার ইজতেমা ময়দান ও টঙ্গী থেকে কোনো মোবাইল অপারেটরেই দেশের অনেক স্থানে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মাঝেমধ্যে লাইন পেলেও মুহূর্তেই কেটে যাচ্ছিলো। ময়দান থেকে মুসল্লিরা তাদের গ্রামের বাড়িতে স্বজনদের মোনাজাত শোনাতে গেলে বার বার লাইন কেটে যায়। মোবাইলফোন কোম্পানিগুলো নেটওয়ার্ক সুবিধা দিতে ইজতেমা উপলক্ষে ইজতেমার আশপাশ এলাকায় অতিরিক্ত মোবাইল টাওয়ার যুক্ত করেও সমস্যার পুরো সমাধান দিতে পারেনি।
দ্বিতীয় পর্বে ২ হাজার জামাত তৈরি: বিভিন্ন দেশে তাবলিগের কাজে বের হতে এবার ইজতেমা স্থলে দ্বিতীয় পর্বে প্রায় ২ হাজার জামাত তৈরি হয়েছে বলে ইজতেমা আয়োজকসূত্রে জানা গেছে। এসব জামাতে কেউ কেউ তিন চিল্লা, এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। অর্ধশতাধিক বিদেশি জামাত তৈরি হয়েছে। আগামী ১৫-২০ দিনে মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদ্দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
ইজতেমায় বিদেশি মুসল্লি: বিশ্বের ৯৫ দেশের তাবলিগ জামাতের ৬ হাজার ৫১৮ জন বিদেশি মেহমান দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন বলে ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরব্বি প্রকৌশলী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানান। এদের মধ্যে ভারত থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক মেহমান আগমন করেন।
দ্বিতীয় পর্বে আরো ৪ মুসল্লির মৃত্যু: বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে আরো চার মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। শনিবার রাতে তিনজন ও রোববার সকালে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ কন্ট্রোল রুমসূত্রে জানা গেছে।
মুসল্লিরা হলেন, কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথেরপেটুয়া গ্রামের নূরুল আলম (৭০)। রাত পৌনে ১১টার দিকে নিজ খিত্তায় অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। একই রাতে মারা যান আবদুল মাবুদ জোয়ার্দার (৫২), তার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সদরের বাদুড়তলা এলাকায় ও ইজতেমা মাঠের নিজ খিত্তায় অসুস্থ হয়ে মারা যান জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ীর থানার চর আদরা গ্রামের আবদুল কাদের (৬০)। এছাড়া ঢাকার একটি হাসপাতালে রোববার সকালে মৃত্যু হয়েছে আখলাক মিয়া (৬০) নামে এক মুসল্লির। তার বাড়ি সুনামগঞ্জে।
ইজতেমা ময়দানে তাদের নামাজে জানাজাশেষে নিজ নিজ এলাকায় মরদেহ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন লাশের জিম্মাদার মো. আদম আলী। বিশ্ব ইজতেমায় দ্বিতীয় পর্বে এক বিদেশিসহ মোট ৭ মুসল্লি মারা যান।
মোনাজাতশেষে যানজট ও জনজট: আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পর পরই মানুষ নিজ গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করে। আগে যাওয়ার জন্য মুসল্লিরা তাড়াহুড়ো শুরু করে। এতে টঙ্গীর আশপাশের সড়ক-মহাসড়কে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ জনজট ও যানজট।
অতিরিক্ত ভাড়া: ইজতেমার মোনাজাতশেষে মুসল্লিরা বাড়ি ফিরতে ভোগান্তিতে পড়েন। টঙ্গী ব্রিজ থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ১০ টাকার ভাড়া একশ’ টাকা এবং একই স্থান থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১০ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা আদায় করা হয়। বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতের ক্ষেত্রেও কয়েকগুণ বেশি বাসভাড়া নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।