আ.লীগ-বিএনপিতে শেষ বেলার হিসাব

স্টাফ রিপোর্টার: রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু না থাকলেও পালা বদলের ক্রান্তিলগ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে চলছে তারই চুলচেরা বিশ্লেষণ। শেষ মুহূর্তে দলে কে আছে, কে নেই; জোট-মহাজোটে যোজন বা বিয়োজন কী হবে; নতুন করে কি কোনো জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটবে দু পক্ষই তার পাকা খাতা তৈরি করে ভোটের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে চলছে জোটের শরিকদের সাথে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এখন যা চলছে তা সেমিফাইনাল। খেলা ফাইনালে গড়াতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা এবং সে সময়কার সরকার ব্যবস্থা কী হবে তা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত ভোটের ছক নানাদিকে ওলটপালট হবে। তাই ছোট ও মধ্য সারির রাজনৈতিক দলগুলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আরো কিছুটা সময় নেবে। এরই মধ্যে কেউ কেউ জোট-মহাজোটকে শেষ কথা দিলেও ভোটের আগে তা পুরোপুরি উল্টে যেতে পারে।

Untitled-1 copy

জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একদলীয় নির্বাচন করতে বিএনপির বিকল্প হিসেবে ১৪ দলের শরিক দল এবং অন্যান্য কয়েকটি দলকে পৃথকভাবে ভোটযুদ্ধে নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে সাময়িকভাবে লাভবান হলেও এ ফল দীর্ঘমেয়াদি হবে না তা টের পেয়ে মহাজোটে থাকা এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এ খেলা থেকে সরে আসতে চাইছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনে না থাকলেও একদলীয় নির্বাচনের ফাঁদে পা দেবে না বলে তারা জানিয়ে দিয়েছে। এ সুযোগে বিএনপি বড় ধরনের ছাড় দিয়ে জাপাকে দলে ভিড়াতে চাইছে। এ নিয়ে দু পক্ষের মধ্যে আলোচনা এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। তবে আসন বণ্টন, এরশাদের মামলা প্রত্যাহার ও মন্ত্রিত্বের ভাগবাটোয়ারার বিষয়ে এখনো কোনো আপস-রফা হয়নি বলে জানান জাপা নেতারা।

এদিকে ক্ষমতার শেষ সময়ে আওয়ামী লীগও জাপার কদর বাড়াতে সচেষ্ট হয়েছে। এরশাদের একাধিক মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে। পাশাপাশি বিএনপি-জাপা যাতে কোনোভাবে ঐক্য গড়ে তুলতে না পারে সেজন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তারা আশাবাদী, জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত মহাজোটেই থাকবে। এদিকে হেফাজতে ইসলাম পুরোপুরি বিএনপিতে ভিড়েছে বলে চাউর হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের একটি বড় অংশ ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে বলে দাবি করেন নেতারা। তারা জানান, এরই মধ্যে এ ব্যাপারে হেফাজতের সাথে কথা হয়েছে। ছোটখাটো কিছু বিষয় ছাড়া অধিকাংশ ইস্যুতে
তারা ঐক্যমতে পৌছেছে। দু-চার সপ্তার মধ্যে হেফাজতের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের প্রথম সারির একাধিক নেতা।
তবে হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা বলেন, তাদের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে একটি চক্র ফায়দা লুটতে চাচ্ছে। গাজীপুরসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু রাজনীতিতে তাদের সমর্থন কোনো দিকে তা তারা আগেই স্পষ্ট করেছে। জাতীয় নির্বাচনে তাদের সমর্থন দোদুল্যমান হবে না বলে দাবি করে হেফাজতের ওই নেতা বলেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের আসন বণ্টনসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে চূড়ান্ত কথাবার্তা হয়েছে। এ ব্যাপারে শিগগিরই তারা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে। তবে সংগঠনের কেউ কেউ গোপনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টার কথা স্বীকার করেন হেফাজতের ওই নেতা।

বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা জানান, নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি বৃহৎ রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে চায়। এ লক্ষ্যে জোটের বাইরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক ও যোগাযোগ হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে জাপা ও হেফাজত নেতাদের সঙ্গেও তাদের কথাবার্তা চলছে। তারা দু দলের কাছ থেকেই শেষ কথা আদায়ের চেষ্টা করছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি জোটের পরিধি বাড়ানোর নীতিগত অবস্থান নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি, হেফাজত বা অন্য কোনো দল যদি তাদের জোটে আসেন তাহলে অবশ্যই তাদের স্বাগতম জানাবেন।

এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মহাজোটের শরিকদের পাশাপাশি নতুন মিত্রদের সন্ধানে তৎপর আওয়ামী লীগও। এ জন্য ইতোমধ্যেই তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাম ও প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি), গণঐক্যসহ অন্তত ৫টি রাজনৈতিক দলের শেষ কথা আদায় করেছে। কোন দলকে কটি আসন দেয়া হবে তা-ও অনেকটা চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।

তবে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ১৪ দলের পক্ষ থেকে জোটে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। কিন্তু তারা এখনই কোনো জোটে যোগ দিতে রাজি নন। তারা দেশে বাম প্রগতিশীল শক্তির বৃহৎ ঐক্যের লক্ষ্যে কাজ করছেন।

জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও আওয়ামী লীগকে চূড়ান্ত কথা দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি। এদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কথা ওয়ার্কার্স পার্টি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও এ ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত যে চূড়ান্ত তার আভাস দিয়েছে। দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে দেশে বিপর্যয় নেমে আসবে। এ অবস্থায় অসামপ্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যের বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঐক্য প্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।

মহাজোটে যোগদানের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে তরিকত ফেডারেশন। সংগঠনের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মুত্তাকিল বিল্লাহ রাব্বানি বলেন, তারা সব সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন, আছেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনকে মহাজোটে যোগদানের প্রস্তাব দিয়েছেন। বিষয়টি তারা সাদরে গ্রহণ করেছেন। এটাই তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ, গণফোরাম, আ.স.ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি ও কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এখনো কাউকে শেষ কথা না দিলেও কোনোভাবেই মহাজোটে যোগ দিচ্ছে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এদিকে রাজনৈতিক কোনো দলের কর্ণধার না হলেও পালা বদলের শেষ সময়ে অঙ্গনে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সর্বোচ্চ কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দা-কুমড়ো সম্পর্ক থাকায় তাকে দলে টানার কোনো সুযোগ না থাকলেও তিনি যাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখতে না পারেন তার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে ড. ইউনূসকে দলে ভিড়াতে না পারলেও বিএনপি তাকে দিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে চাইছে। এরই মধ্যে তারা এ ব্যাপারে নিজেদের বেশকিছুটা এগিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক ইমেজ কাজে লাগিয়ে বিএনপি বেশ কটি প্রভাবশালী দেশ ও দাতাগোষ্ঠীর সহানুভূতি আদায়ে সক্ষম হয়েছে জানা গেছে।

অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সমমনা দল নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ লক্ষ্যে তিনি অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। ড. কামাল হোসেনের গণফেরাম, বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, মাহমুদুর রহমানের নাগরিক ঐক্য পরিষদ ও আ স ম আব্দুর রবের জাসদসহ সমমনা ১০টি দল নিয়ে নতুন জোট গঠনের ব্যাপারে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চূড়ান্ত আলোচনা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে শিগগিরই তাদের মাঠে নামার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কার ভাগে কতটা আসন পড়বে এ নিয়ে কোনো আলোচনা এখনো হয়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে ড. ইউনূসের রাজনীতিতে আগমন ও নতুন জোট গঠনে কার কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হবে তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এ বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করছে। যদিও দলের একাধিক নেতা ড. ইউনূসকে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য, ওয়ান ইলেভেনের আগেও তিনি হাঁকডাক দিয়ে রাজনীতির মাঠে নামার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ সময় তিনি তার পেছনে কাউকে খুঁজে পাননি। তাকে গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়া হয়েছে- মন্তব্য করে ওইসময় তিনি পিছু হটেছিলেন। এবারো এমনটাই হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমনটি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা প্রধান বিরোধী দল বিএনপিই অনেকটা প্রকাশ্যেই ড. ইউনূসকে রাজনীতিতে টেনে আনার চেষ্টা করছে। বিশেষ উদ্দেশে একটি প্রভাবশালি মহল গোপনে তাদের সহযোগিতা করছে। তাই সরাসরি রাজনীতির মাঠে না নামলেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে ড. ইউনূস আওয়ামী লীগের জন্য নিশ্চিত পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেন বিশ্লেষকরা।