আস্থাহীনতায় আটকে আছে কওমি সনদের স্বীকৃতি

 

স্টাফ রিপোর্টার: কওমি মাদ্রাসাগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে সরকার এর শিক্ষার্থীদের দেশের মূল ধারার সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছে। তবে সরকারের উপর আস্থাহীনতা, অবিশ্বাস, সন্দেহ আর সংশয়ের কারণে বেশিরভাগ কওমি মাদরাসা সে স্বীকৃতি নিতে দ্বিধায় ভুগছে। তাদের শঙ্কা, সরকার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে। তাই এ বিষয়ে সরকারের নানা উদ্যোগ অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে।  জানা গেছে, দেশের কওমি মাদরাসাগুলো অরাজনৈতিক, বেসরকারি ও জনগণের দানের ওপর নির্ভর করে চলছে। নিজেদের অবস্থানকে সর্বদাই রাজনীতির বাইরে রেখে পরিচালিত হয়ে আসলেও ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা শাহবাগ আন্দোলনে হেফাজতে ইসলামের কার্যকলাপের কারণে বিতর্কের সামনের সারিতে চলে আসে দেশের কওমি মাদরাসা ও তার শিক্ষা ব্যবস্থা। হেফাজতে ইসলামের রাজধানী ঢাকা অবরোধ ও সরকারের অপারেশনের মাধ্যমে সেখান থেকে তাদের হটানোর পর সরকার ও কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষের মধ্যকার বিরোধ ও তিক্ততা নতুন রূপে সামনে আসে। আর এর ঠিক পরেই সরকারের কওমি মাদরাসাকে স্বীকৃতি দেয়ার জোর চেষ্টাকে তাই মোটেও স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না দেশের কওমি মাদরাসাগুলো। তাদের মতে সরকার তার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই এ উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলছে ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশে অপারেশনের পর থেকে সরকার এ উদ্যোগে গতি আনলেও এর আগে তা কখনই দেখা যায়নি।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু কওমি মাদরাসার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অধিকাংশ মাদরাসাই তাদের প্রতিষ্ঠানের সরকারি স্বীকৃতির পক্ষে। কারণ তারা মনে করেন কওমি মাদরাসা সরকারি স্বীকৃতি পেলে সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণকারীরা বিভিন্ন সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও কাজ করার সুযোগ পাবেন। যা তাদের শিক্ষার্থীদের একটি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ উপহার দেবে। তবে সরকার মাদরাসার পাঠ্যবই ও সিলেবাসে পরিবর্তন আনতে চাইবে কিনা সেটিই তাদের প্রধান শঙ্কার কারণ। এছাড়া কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারমান থেকে শুরু করে মাদরাসা সুপার, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ নিয়েও তারা সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। অধিকাংশ কওমি কর্তৃপক্ষের ভাষায় সরকার স্বীকৃতি দিতে চাইলে তারা স্বাগত জানাবে। তবে অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চাইলে তাদের স্বীকৃতির প্রয়োজন হবে না।  বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কওমি মাদরাসার প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বেফাকুল মাদারিসিলি আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) এর সহকারী মহাপরিচালক হযরত মওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃতির জন্য কথা বলছেন। বর্তমান সরকারও কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে দৃশ্যমান চেষ্টা করছে। তারা দেশের সব কওমি মাদরাসার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পক্ষে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে তাদের শিগগিরই বসার কথা আছে। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাদের আমির আল্লামা আহম্মদ শফি হাসপাতালে থাকায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে যখন সেটি সম্ভব হবে তখন তারা সেখানে তাদের দাবি-দাওয়ার পক্ষে যুক্তি-তর্ক তুলে ধরবেন। তবে নিজেদের স্বতন্ত্রতা রক্ষা করেই তারা সেটি করতে চান। স্বতন্ত্রতা রক্ষার কেন প্রয়োজন, এমন প্রশ্নের জবাবে যোবায়ের আহমদ বলেন, এটি কুরআন-হাদিসের গবেষণা ও উচ্চতর শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। এর উদ্দেশ্য দুনিয়ামুখিতা নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশ্য ও তাদের উদ্দেশ্য এক নয়। ১৮৬৬ সালে ভারতের দেওবন্দে ও ১৯০১ সালে বাংলাদেশের হাটহাজারিতে প্রথম কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। যার উদ্দেশ্যই ছিলো আল্লাহর প্রিয় বান্দা তৈরি করা। দীনের বাণীকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। এবং ইসলামি মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটানো। তারা সে উদ্দেশ্য থেকে সরে এলে তাদের সঙ্গে দেশের সাধারণ শিক্ষার কোনোই পার্থক্য থাকে না। আর এ কারণেই তারা স্বতন্ত্রতা রক্ষার কথা বলছেন। তিনি বলেন, ভারত থেকে কেউ দাওরায়ে হাদিস (মওলানার সর্বশেষ সেমিস্টার) পাস করলে তাকে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্সের সমমান দেয়া হয়। তবে সে দেশের সরকার এখানে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না। তার পরেও স্বীকৃতি দিচ্ছে। তাদের স্বীকৃতি দিতেই হবে এমন কোনো কথা বলছেন না, তবে সরকার চাইলে নিঃশর্ত স্বীকৃতি হবে।
জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞানের জন্য সরকার সহায়তা দিলে এখানকার শিক্ষার্থীরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে বলেও মনে করেন না বেফাকের সর্বোচ্চ পর্যায়ের এ নেতা। তিনি বলেন, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর বিনা মূল্যে থাকা, খাওয়া, পরা, চিকিৎসা ও লেখাপড়ার সব খরচ যদি সরকারি সহায়তা ছাড়াই নিজেরা মেটাতে পারেন তবে এটিও তারা পারবেন। এবং এরই মধ্যে এ ধরনের অনেক কম্পিউটার ল্যাব ও বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে বলেও জানান বেফাকের এ কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে ইলহাকুল মাদারিস মাদরাসা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন সদস্য মওলানা আবুল কাশেম বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়ে আসছেন। তবে হস্তক্ষেপ চান না। কওমি ব্যবস্থায় স্বতন্ত্রতা না থাকলে কুরআন হাদিসের এ প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সরকারি হস্তক্ষেপ হওয়ার পর অতীতের আলীয়া মাদ্রাসা এখন তাদের স্বতন্ত্রতা হারিয়ে সাধারণ স্কুল কলেজের মতোই রূপ ধারণ করেছে। তারা চান না তাদের প্রতিষ্ঠানও এমন দেউলিয়া হোক। তারা সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারেন এমন কোনো কিছু সরকার এখনও দেখাতে পারে নি। সরকারি নিয়ন্ত্রণে গেলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার যদি না চায় তবে তখন এ শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাতিল বা সম্পূর্ণ বদলে ফেলতে পারে। তারা এ কারণে এ ধরনের কোনো ঝুঁকিতে যেতে চান না। জানা গেছে, ২০১৪ সালে সরকার কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি দেয়ার জোর চেষ্টা করলে শোলাকীয়া ঈদগাহের ইমাম ফরিদ উদ্দিন মাসুদ ছাড়া বাকি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কওমি নেতাকে সরকার পাশে পায়নি। অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসাই সরকারের এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদগার শুরু করলে সরকার বাধ্য হয়ে কিছুটা পিছু হটে। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে কওমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার দিকে মন দেয় সরকার। সূত্রের তথ্য মতে, ২০১৪ সালের পর সরকারের সাথে কওমি কর্তৃপক্ষের বহু আলাপ আলোচনা হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বসার কথা খুব শিগগিরই। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গেও কওমি কর্তৃপক্ষের কয়েকবার মিটিং হয়। যার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, কওমি মাদরাসার স্বীকৃতির ব্যাপারে খুব শিগগিরই ইতিবাচক ঘোষণা আসবে। তাদের সঙ্গে সরকারের ইতিবাচক আলোচনা চলমান আছে। বাস্তবেও খুব শিগগিরই এ বিষয়ে কার্যক্রম দেখা যাবে।
সরকারের দেয়া তথ্যমতে, সারাদেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদরাসা রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি মাদরাসা, ৪ হাজার ৫৯৯টি। সবচেয়ে কম বরিশালে ১ হাজার ৪০টি। বেশির ভাগ মাদরাসাই মফস্বল এলাকায় অবস্থিত।
সরকারি তথ্য বলছে, মোট কওমি মাদ্রাসার মধ্যে ১২ হাজার ৬৯৩টি পুরুষ ও ১ হাজার ২০৯টি মহিলা মাদ্রাসা রয়েছে। এসব মাদ্রাসায় ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৩৬ জন ছাত্র ও তিন লাখ ৩৯ হাজার ৬১৬ জন ছাত্রী পড়াশোনা করছে। সারাদেশে শিক্ষক আছেন ৭৩ হাজার ৭৩১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬৬ হাজার ৯০২ জন এবং মহিলা ৬ হাজার ৮২৯ জন।
সংখ্যার দিক দিয়ে ঢাকার পরেই চট্টগ্রামে মাদরাসা বেশি, ২ হাজার ৯৮৪টি। এর পরে রাজশাহীতে ১ হাজার ৭০২টি, সিলেটে ১ হাজার ২৪৬টি, রংপুরে ১ হাজার ১৭৬টি, খুলনায় ১ হাজার ১৫৫টি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের শেষ দিকে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ জন্য ‘বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। এই কর্তৃপক্ষ গঠনের জন্য আইনের খসড়া অর্থ, জনপ্রশাসন ও প্রশাসনিক প্রণয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় অনুমোদন শেষে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও উত্থাপন করা হয়। কিন্তু কওমি কর্তৃপক্ষের তীব্র বিরোধিতার মুখে সরকার খসড়াটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফেরত পাঠায়। এরপর থেকেই সরকার নানাভাবে কওমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে একটি আপসে আসার চেষ্টা করলেও কওমি কর্তৃপক্ষ সরকারের ওপর আস্থা রাখতে না পারায় তা এখনও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।