আলোকিত মানুষের অন্ধকারের কথা

স্টাফ রিপোর্টার: আর দশটা মানুষের মতই কারিম এই পৃথিবীকে দেখেছেন দু চোখ ভরে। দেখেছেন মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের। দেখেছেন তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের চোখের স্বপ্ন। দুখের কান্না। স্কুল-কলেজে যাওয়া। বাজার করা। আড্ডা দেয়া। জীবনের সবই ছিলো স্বাভাবিক মানুষের মতো। সবই উপভোগ করেছেন দু চাখের আলোর ছটায়। এখন তার পৃথিবীর সবটাই অন্ধকার। ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা তার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে তার সকল স্বপ্ন। তারপরও এই অন্ধকারকে পেছনে ফেলে কারিম মনের আলোয় জীবনকে আলোকিত করতে শুরু করেছে অন্য যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সরকারের দেয়া আলোর দিশাকে তিনি কাজে লাগাতে চান। চান আজকের অক্ষমতাকে উপক্ষা করে নিজের যোগ্যতাতে প্রতিষ্ঠিত হতে। তবে সরকারের দেয়া সুযোগ সুবিধা কখনও কখনও হারিয়ে যায় কিছু মানুষের অবহেলা ও উদাসীনতার জন্য।
মো. আব্দুল কারিম (২৬) চুয়াডাঙ্গা সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের একজন ছাত্র। বাবা মো. আব্দুস সাত্তার। মা মোছা. রাবেয়া খাতুন। বাড়ি ঝিনাইদহ হলিধানী বাজার এলাকার কোলা ঢাকাপাড়ায়। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। ৩ ভাই আর ২ বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবা দরিদ্র কৃষক। অন্যান্য ভাই-বোন পড়ালেখা করার সুযোগ পাননি। তবে কারিমের আগ্রহের কারণে ঝিনাইদহের হলিধানী আলিম মাদরাসায় তাকে ভর্তি করে দেয়া হয়। সেখান থেকে ২০০৪ সালে দাখিল, ২০০৬ সালে আলিম পাস করেন তিনি। ২০০৭ সালে ফরিদপুর কৃষি ডিপ্লোমা কলেজে ভর্তি হন। তবে আর্থিক সমস্যার কারণে এক সেমিস্টার পর ডিপ্লোমা পড়ার ইতি টানতে হয়। বুকে অতৃপ্তির কষ্ট নিয়ে তিনি ফিরে আসেন গ্রামে। শুরু করেন বাবার সাথে কৃষিকাজ। সব ঠিকঠাক চলছিলো। হঠাত ২০০৯ সালের জুনে টাইফয়েড আক্রান্ত হন কারিম। তার অবস্থা গুরুতর হলে খুলনা আড়াইশ’ বেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে।
কারিম জানান, সেখানে টাইফয়েডের পরিবর্তে টিউমারের চিকিৎসা দেয়া হয় তার। এ কথা তিনি জানতে পেরেছিলেন অনেক পরে। যখন তার দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করেছে। নার্ভের ব্লাড কানেকশন বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকায় চিকিৎসা নেয়ার সময় ডা. আব্দুল হাই’র নিকট থেকে তিনি বিষয়টি নিশ্চিত হন। তখন আর কিছু করার নেই তাদের। অন্ধকার পৃথিবী কারিমকে স্তব্ধ করে দেয়। নানা চিন্তা তার মনে ভিড় করে। চান সবাইকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। যেখানে তিনি জীবনটাকে নতুন করে শুরু করবেন। মনে পড়ে চুয়াডাঙ্গা আদর্শ বালক বিদ্যালয়ে স্কাউট ট্রেনিং-এর কথা। যেখানে তিনি দেখেছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা এবং থাকার ব্যবস্থা। বন্ধুদের সহায়তায় ২০১০ সালের জুনে চুয়াডাঙ্গা সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলে আসেন তিনি। সেখানে রিসোর্স শিক্ষক মনোজ কান্তি রায়ের সাথে দেখা করে তার ইচ্ছার বিষয়টি জানান। গোপন করেন তার আলিম পাসের বিষয়ে। ভর্তি হতে চান চতুর্থ শ্রেণিতে। মনোজ কান্তি রায় কারিমের কথাবার্তায় বিষয়টি বুঝতে পারেন। শুরু করে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া শেখা। সেই সাথে তাকে ঝিনাইদহ সিদ্দিকিয়া কামিল মাদরাসায় ফাজিল ভর্তি করে। অবশেষে ২০১৩ সালে ফাজিল পাস করে। বর্তমানে বদরগঞ্জ বাকিবিল্লা কামিল মাদরাসায় তিনি কামিল পড়ছেন।
পড়ালেখার পাশাপাশি কারিম চাকরি খুঁজতে শুরু করেছেন। চুয়াডাঙ্গা সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষ্যা কার্যক্রমের রিসোর্স শিক্ষক মনোজ কান্তি রায় জানান, সরকারি নিয়োগ বিধিতে ১% প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা বরাদ্দ আছে। গত প্রাইমারি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে কারিম ঝিনাইদহ সদর উপজেলা থেকে সহকারী শিক্ষকতা পদের জন্য আবেদন করেছিলেন। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো ইন্টারভিউ কার্ডটি পর্যন্ত তিনি পাননি।
তিনি আরও জানান, প্রতিবন্ধীদের কোটায় শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নেয়া হলেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদেরকে একটু অবহেলা করা হয়। তাদের নিয়োগ কম দেয়া হয় বলে তিনি মনে করেন। বিষয়টি প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি দেয়া দরকার।
কারিম অবশ্য থেমে থাকেননি, তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদফতরের স্থায়ী রাজস্ব খাতে শূন্য পদে সহকারী শিক্ষকের পদে আবেদন করেছেন। এখন অপেক্ষায় ইন্টারভিউ কার্ডের। চোখের আলো হারালেও মনের আলো দিয়ে কারিম তার জীবনের অন্ধকারকে জয় করতে চায়। আপনিও সহায় হতে পারেন তার।