সাধক মেহেরপুরের বলরাম হাড়ি

 

মহাসিন আলী: আঠার শতকের শেষের দিকে (সম্ভাব্য ১৭৮৫ সালে) মেহেরপুর শহরের মালোপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলরাম হাড়ি নামের এক আধ্যাত্মিক সাধক। তিনি প্রবর্তন করেছিলেন বলরাম বা হাড়িধর্ম নামের এক লৌকিক গৌণ ধর্ম। আঠার শতকের শেষের দিকে বা উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এই লোকধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হয়। বলরাম হাড়ি প্রবর্তিত এই লোকধর্ম নিন্মবর্গীয় অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্য শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলরাম হাড়ির চেলাদের লক্ষ্য করে গেয়েছেন- কোনো বলরামের আমি চেলা। চৈতন্য, লালন সাঁইজির মতো তিনিও মুক্ত চিন্তার মুক্ত মানুষ হিসেবে সারাজীবন শাস্ত্র আর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গন্ডির বাইরে দাঁড়িয়ে মানব প্রেমের মহিমা প্রচার করে গেছেন।

মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক লোক গবেষক আব্দুল্লাহ আল আমিন বিভিন্ন তথ্যসূত্রের আলোকে জানান- উচ্চ বর্ণের মানুষকে দলে নিতে চাননি বলে বলরাম হাড়ির প্রায় ২০ হাজার নি¤œবর্ণের ভক্তের মধ্যে ছিলো হাড়ি, মুচি, ডোম, বাগদী, নমঃ শুদ্র এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমান। যদিও তারা সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দুও নন; মুসলিমও নন। বাউলদের মতো বলরামীরাও বংশানুক্রমিক নয়, দীক্ষা নিয়েই এ ধর্মে অন্তর্ভুক্ত হন। এ কারণে তাদের কোন শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থ পাওয়া যায়না। নি¤œবর্ণের মানুষগুলো বৈদিক মন্ত্রের মহিমা কিংবা গঙ্গাজলের পবিত্রতায় বিশ্বাস করতেন না। তাদের উপাস্যের নাম বলরাম হাড়ি যাকে হিন্দুভক্তরা বলতেন হাড়িরাম আর মুসলমান শিষ্যরা বলতেন হাড়ি আল্লা।

বাংলাদেশের মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুর এবং পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া, বীরভূম, বর্ধমান ও কোলকাতা অঞ্চলে এই ধর্ম বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ভক্ত শিষ্যের অধিকাংশই বাউল-বৈষ্ণবদের মতো ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের মধ্যে গৃহী ও সন্নাসী উভয় প্রকার ভক্তই ছিলো। হাড়ি সম্প্রদায়ের সন্নাসীরা বিয়ে করেন না। কিন্তু গৃহী সম্প্রদায়ের ভক্তরা বিয়ে করেন।

বলরাম হাড়ি বাল্যকাল থেকে ধর্মানুরাগী ও সত্যনিষ্ঠ ছিলেন। যৌবনের শুরুতে তিনি মেহেরপুরের প্রতাপশালী জমিদার পদ্মলোচন মল্লিকের বাড়িতে চৌকিদার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। মল্লিক বাড়ির কিছু স্বর্ণালংকার চুরি হয়ে গেলে তাকে সন্দেহ করা হয়। এতে তিনি অত্যন্ত মনঃকষ্ট নিয়ে চাকরী ছাড়েন এবং নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ওই সময় তিনি বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুরে বিপুল আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারি হন। অবশেষে তিনি উপাস সম্প্রদায় নামে একটি ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। যা বলরামী সম্প্রদায় নামে পরিচিত। বৈষ্ণবরা যেমন শ্রী চৈতন্যকে কৃষ্ণের অবতার মনে করেন, তেমনি বলরামের ভক্তরা তাকে রামের অবতার বলে মনে করেন। বলরামও তার শিষ্যদের ইশারা ঈঙ্গিতে সেকথায় জানান দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন- “আমি আপন শরীর থেকে এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছি। লোকে আমাকে নীচ হাড়ি বলে জানে। কিন্তু আমি সাধারণ হাড়ি নই। আমি হাড়ের সৃষ্টি করেছি। তাই আমি হাড়ি।

১৮৫০ সালে ৬৫ বছর বয়সে বলরাম হাড়ি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পরে সাধু দরবেশদের মতো তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান তার সাধন সঙ্গী, সেবাদাসী ব্রহ্মমালেনী বা বহ্মময়ীকে। বলরামীদের কাছে বলরাম ছিলেন ভগবান। যিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের মালিক। ভক্তরা মনে করতেন যে, তিনি পূর্ণব্রহ্ম সনাতন। মেহেরপুরের এক দানশীল জমিদার জীবন মুখার্জী এই মহান সাধকের স্মৃতি রক্ষার্থে দান করেন ৩৫ শতাংশ জমি। ওই জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বলরাম হাড়ির সমাধি মন্দির।

মেহেরপুর শহরের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক শ্বাশত চক্রবর্তী ওরফে নিপ্পন বলেন- প্রতিবছর বারুনী তিথিতে এই মন্দির প্রাঙ্গণে বলরামী সম্প্রদায়ের উৎসব হয় ও মেলা বসে। বলরাম হাড়ির ভাবাদর্শের অনুসারী মেহেরপুর অঞ্চলে এখন তেমন আর দেখা যায় না। তবে এখন বলরামী সম্প্রদায়ের স্বরূপ ও প্রকৃতির সাথে ভারতের নদীয়া জেলার অন্যান্য লোক ধর্মগুলির প্রকৃতি ও স্বরূপের মিল রয়েছে। বলরাম হাড়ির সর্বশেষ সেবাইত বৃন্দাবন হালদার ১৯৮৫ সালে ৮০ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন।