সড়ক মৃত্যুপুরী : অথচ সকলেই স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চায়

সড়কের নাম এখন মৃত্যুপুরী। বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের সড়কগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। রাস্তায় বের হয়ে সুহালে বাড়ি ফেরার ন্যূনতম নিশ্চয়তা নেই। শ্যালোইঞ্জিনচালিত হরেক নামের অবৈধ যান কখন যে কার ওপর ওঠে, কার কাড়ে প্রাণ, কে হবে পঙ্গু তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এসব ঘটনা যেমন প্রশাসনের সামনেই ঘটছে। তেমনই অবৈধ যান চালকদের নিকট থেকে নানাভাবেই আদায় করা হচ্ছে অর্থ। মাঝে মাঝে অবৈধ যান প্রধান প্রধান সড়ক থেকে উচ্ছেদের দাবি তীব্রতর হয়। প্রশাসন নড়ে চড়ে বসে। কিছুদিনের মাথায় পরিস্থিতি সেই একই তিমিরে ফেরে। প্রতিকার মেলে না, মিলবে বলে মনেও হয় না। তা হলে বৈধতা দিলেই তো হয়! বৈধতা পেলে অন্তত চালকের দক্ষতা দেখার সুযোগটা সৃষ্টি হয়। তাতেও তো কিছুটা ঝুঁকি হ্রাস পেতো।

 

যোগাযোগ ব্যবস্থা তরান্বিত হয়েছে। অনেকেই এ অবৈধ যানের মাধ্যমে কর্মসংস্থান পেয়েছে, সংসারে সচ্ছ্বলতা এনেছে অজুহাতে আইন প্রয়োগে নমনীয়তা দেখানোর রেওয়াজ বিদ্যমান। এ সুযোগে কিছু স্থানে প্রকাশ্যেই এসব অবৈধ যানের চালকদের নিকট চাঁদাবাজিও করা হয়, হচ্ছে। পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার নামে টাকা তোলা হয় বলে অভিযোগ মাঝে মাঝেই উত্থাপিত হয়। কর্তাদের তেমন কর্ণপাত হয় বলে মনে হয় না। অবৈধ যান তো সড়কে মানুষের প্রাণ কাড়ছে, এখন ঘরে থাকা মানুষেরও প্রাণ কাড়তে শুরু করেছে। কীভাবে? শব্দ দূষণ করে। একেতো অবৈধ যান, তার ওপর আবার বিশেষভাবে শব্দ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কেটে শব্দ এতোটাই বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে যে, ঘরে থাকা মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হতে বাধ্য। প্রশাসন এসব না দেখলে কে দেখবে? সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা? প্রশাসন তো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধেই অভিযোগের তীর নিরিখ করে। রাজনৈতিক নেতাদের তদবিরেও নাকি অবৈধ যান সড়ক থেকে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি, হচ্ছে না। তা হলে সমাজের সাধারণ মানুষকে এভাবে মরা ছাড়া গত্যান্তর আছে কি?

 

অবৈধ যান অবশ্যই গ্রামবাংলায় যোগাযোগ মাধ্যমকে তরান্বিত করেছে। অনেকেরই সংসারে সচ্ছ্বলতা এনেছে। কিন্তু এ সচ্ছ্বলতার তুলনায় কতোজনকে পঙ্গু করে, উপার্জনক্ষম পুরুষের প্রাণ কেড়ে কতোটা পরিবারকে অসহায় করে তুলেছে, তার পরিসংখ্যান কি কর্তাদের নখদর্পণে আছে? হাসপাতালগুলোতে দায়িত্বশীল চিকিৎসকদের সাথে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আলোচনা করলে অংশবিশেষ চিত্র প্রশাসনিক কর্তারা পাবেন বলে বিশ্বাস। প্রতিদিনই অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবৈধ যানের বেপরোয়াগতি, অদক্ষ চালক, রাতে প্রয়োজনীয় আলো এবং সংকেতবাতি না থাকাটা দায়ী। গতকাল দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় দুর্ঘটনা বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথক দুটি দুর্ঘটনায় অবৈধ যান আলমসাধুর তিন চালক আহত। তিন জনেরই পা গুঁড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ পঙ্গুত্বের বোঝা নেমে এসেছে। এভাবে একের পর এক ব্যক্তি পঙ্গু হচ্ছে, পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ ঝরে পড়ছে।

 

প্রায় দু যুগ আগেরও অধিক সময় ধরে তিন চাকার ভ্যানে শ্যালোইঞ্জিন লাগিয়ে মালামাল বহন হয়ে আসছে। মালামাল বহনের পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে বসিয়ে যাত্রীও বহন করছে এসব অবৈধ যান। এরপর চার চাকার ট্রাকের আদলে অবৈধ যান তৈরি করে শ্যালোইঞ্জিন যুক্ত করে দিব্যি চালানো হচ্ছে রাস্তায়। বহন করা হচ্ছে গরু-ছাগল মানুষ-ভেড়া মালামাল। লাটাহাম্বার নামের অবৈধ এ যান রাস্তায় চলে দানবের মতো। কতোজনের যে প্রাণ কাড়ছে তার পরিসংখ্যান মিলছে না। কেন? এজাহার দুরাস্ত, থানায় একটি জিডিও হচ্ছে না। বৈধ যানবহন দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীলদের যেভাবে আইন প্রয়োগের কথা বলা হয়, অবৈধ যান দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সেভাতে নয়ই বরঞ্চ গোপন করার জন্যই যেন সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। অথচ লাইসেন্স ছাড়া কোনো চালকের হাতে দুর্ঘটনা ঘটলে তার বিরুদ্ধে অনেকটা হত্যার মতোই কঠোর আইন প্রয়োগের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আর অবৈধ যানের অবৈধ চালক প্রাণ কাড়লে মামলাই হচ্ছে না। অপরাধ করে পার পেলে অপরাধী নিজেকে সুধরে নেয় না, বরঞ্চ অপরাধকে অপরাধ বলেই মানতে চায় না। তা না হলে অবৈধ যানের শব্দ নিয়ন্ত্রণ চোং কেটে শব্দ দূষণের দিকে পা বাড়ায় কীভাবে? কোন সাহসে?

 

আইন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ, কারো কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারায়। বৈধ যানবাহনের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ হবে, অথচ অবৈধ যান পার পেয়ে যাবে। এটাকে আইনের শাসন বলা যায় না। আইন  সকলের জন্য সমান, সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে সমাজকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুনোর পথের অর্ধেকই এগিয়ে যাওয়া হয়ে যায়। অবশ্যই সকলে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চায়। অস্বাভাবিক অপমৃত্যু কাম্য নয়। সর্বক্ষেত্রে যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমাজ থেকে অপরাধ প্রবণতা দূর করতে হবে। সড়কগুলো মৃত্যুপুরী নয়, যোগাযোগের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবেই গড়তে হবে। তা করতে হলে আইন প্রয়োগে নমনীয়তা নয়, আইন প্রয়োগে অনমনীয় আন্তরিকতা প্রয়োজন।