যে মর্মন্তুদ চিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে তা অত্যন্ত বেদনাবিধুর

পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলে পাহাড় ধসে দু’জন সেনা কর্মকর্তা ও কয়েকজন সেনা সদস্যসহ হতাহতের সংখ্যা দেড়শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে দিয়ে যে মর্মন্তুদ চিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে তা অত্যন্ত বেদনাবিধুর। প্রায় প্রতি বছরই পাহাড় ধসে মানুষ মারা যাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। অতীতে বড় ধরনের পাহাড় ধসে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার পর দেশব্যাপী পাহাড় কাটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও প্রতিবাদ হয়। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটাকে দায়ী করা হয় অথচ প্রায় নিয়মিতভাবেই নির্বিচারে চলছে পাহাড় কাটা। এর ফলে যে শুধু সৌন্দর্যহানিই ঘটছে তাই নয়, প্রকৃতির ওপর ভয়াবহ অত্যাচারও হচ্ছে। এই অত্যাচারের প্রতিশোধ প্রকৃতি নিচ্ছে এবং মাশুল দিতে হচ্ছে মানুষকে জীবন দিয়ে।

দেশে ১৯৯৫ সাল থেকে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ হলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার। পৌরাণিক উপাখ্যানে পাওয়া যায়, লখিন্দরকে লোহার ঘরে রাখা হয়েছিলো যাতে সাপে কাটতে না পারে। কিন্তু কারিগর তাতে ছোট্ট একটি ফুটো রেখে দিয়েছিলেন। আর তা দিয়েই সাপ ঢুকে লখিরন্দরকে দংশন করেছিলো। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে পরিবেশ অধিদফতর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলো। প্রজ্ঞাপনে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ থাকার কথা উল্লেখ করে যথাযথ শাস্তির বিধান রাখা হয়। তবে ‘অনিবার্য প্রয়োজনে’ পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় বা টিলা কাটা এমনকি মুড়িয়ে ফেলা যাবে তাও উল্লেখ করা হয়। আর সেই ‘অনিবার্য প্রয়োজনে’র অজুহাত দিয়ে বৈধভাবে যেমন পাহাড় কাটা হচ্ছে তেমনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এও অভিযোগ আছে যে, সংশ্লিষ্ট মহলের অসাধু দায়িত্বশীল কর্তাদের খুশি করে অবৈধভাবে পাহাড় নিধন চলছে। চলছে বনাঞ্চল ধ্বংসযজ্ঞও। চট্টগ্রামের সিংহভাগ এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই পানি থৈ থৈ করে এবং পানি নিষ্কাশনের পথগুলো রুদ্ধ। আর এসব কিছুর বিরূপ ধাক্কা গিয়ে লাগে প্রকৃতি সৃষ্ট সম্পদে এবং একপর্যায়ে আঘাতে এসব ভেঙে পড়ে ধ্বংসযজ্ঞে রূপলাভ করে। চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সুরক্ষার অনেক উদ্যোগ-আয়োজন বছরের পর বছর ঝুলে আছে আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষকে কখনো কখনো জীবন দিয়ে। পাহাড় কাটার ফলে যে কেবল দুর্ঘটনাই ঘটছে তাই নয়, দেশে প্রাকৃতিক পরিবেশও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। জীববৈচিত্র্যেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। পাহাড়ের বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে বসবাসকারীদের জীবন পড়ছে চরম হুমকির মুখে। পুনর্বার পাহাড় ধসের ঘটনায় যে মর্মন্তুদ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো তাতে আমরা গভীর মর্মাহত-শোকাহত।

প্রায় প্রতি বছর পাহাড় ধসে জীবনের এমন মর্মান্তিক ঘটনা এবং প্রকৃতির বিনাশ আমরা আর দেখতে চাই না। পাহাড়-টিলা রক্ষাসহ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সব রকম পদক্ষেপ নিতে হবে নির্মোহ অবস্থান নিয়ে সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি অনেকটাই মনুষ্য সৃষ্ট এই বিপর্যয়ের আমরা প্রতিকার দাবি করি। বিশ্বের সর্বত্র যখন প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি রক্ষার জন্য আন্দোলন চলছে তখন চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড। অনতিবিলম্বে তা বন্ধ হওয়া উচিত।প্রকৃতি ধ্বংস করে যে উন্নয়ন চিন্তা করা হয় তাতে উন্নয়ন না বলে মানব সভ্যতা বিলীনের পথ প্রশস্ত করার উদ্যোগ বলাই শ্রেয়। উন্নয়ন চাই কিন্তু প্রকৃতি বিনাশ করে নয়। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল এর জন্য দ্রুততার সাথে সরকারের তরফে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া বাঞ্ছনীয়।