প্রতিটি জয়ই আমাদের নূতন শৃঙ্গ নির্মাণের সোপান

মানুষ ততোটাই বড়; যার স্বপ্ন যতো বড়- কথাটা বাস্তবে পরিণত করলো বাংলাদেশ। খুব বেশি দিন নয়, ৫/৬ বছর আগেও টাইগাররা মাঠে নামতো সম্মানজনকভাবে হারার জন্য। কিন্তু সেই বৃত্ত থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে তারা। এখন শুধু জয়ই নয়; সিরিজ জয় থেকে হোয়াইটওয়াশের স্বপ্নও দেখে মুশফিকের দল। আর সেই স্বপ্নই তাদের করেছে আরও পরিণত। ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশের স্বপ্ন দেখে তা বাস্তবে পরিণতও করেছে টাইগাররা। সফরকারীদের দেয়া ৩০৮ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে তরুণ ব্যাটসম্যান শামসুর রহমান শুভর ৯৬ ও নাঈম ইসলামের ৬৩ রানে ভর করে বেশ সাচ্ছন্দেই জয় ছিনিয়ে নিয়েছে টাইগাররা। হাতে ছিলো চার উইকেট ও চার বল।

 

২০০৯ সালের আগস্টে জিম্বাবুয়ের বেধে দেয়া ৩১৩ রান তাড়া করে জিতেছিলো বাংলাদেশ। বৃথা গিয়েছিলো চার্লস কভেন্ট্রির তখনকার বিশ্ব রেকর্ড ছোঁয়া ১৯৪ রানের ইনিংসটি। বাংলাদেশি ওপেনার তামিম ইকবালের ১৫৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিলো ৪ উইকেটের জয়। তামিম আজ নেই। তবে আরেক বাংলাদেশি ওপেনার তামিমের কাজটা অনেকখানিই করে দিয়েছেন শামসুর রহমান। মাত্রই আগের ম্যাচে অভিষিক্ত শামসুর রহমান ৯৬ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংসে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন দারুণ এক ভিত্তি। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে বাংলাদেশ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে কি-না, সেটি এখন নির্ভর করছে বাকিদের ওপর। তিনশর বেশি রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড একটিই হলেও গত বছর এশিয়া কাপে শচীন টেন্ডুলকারের শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির রেকর্ড ম্লান করে দিয়ে বাংলাদেশ পাঁচ উইকেটে ম্যাচটি জিতেছিলো। সেবার বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিলো ২৯০। তামিমের ৭০, জহুরুল ইসলামের ৫৩, নাসির হোসেনের ৫৪ রানের পর ৩১ বলে সাকিব আল হাসানের ৪৯ এবং ২৫ বলে মুশফিকুর রহিমের অপরাজিত ৪৬ ভারতের বিপক্ষে স্মরণীয় এক জয় এনে দিয়েছিলো বাংলাদেশকে। ২৫০ কিংবা এর বেশি রান তাড়া করে জেতার আর দুটো রেকর্ড আছে বাংলাদেশের। ২০০৯ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ২৭৫ তাড়া করে জিতেছিলো বাংলাদেশ। ২০০৫ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আছে ২৫০ করে জেতার সেই অবিস্মরণীয় কীর্তি। এখন কি সেই তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছে আরও একটি অধ্যায়? নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বিগত ছয়টা ওডিআই ক্রিকেট ম্যাচে বাংলাদেশের নিরবচ্ছিন্ন সাফল্যের অনেক কারণ রয়েছে। ক্রিকেট ইতিহাসে এ হোয়াইটওয়াশ আমরা অসংখ্যবার হয়েছি। আমাদের প্রতীক বাঘ হলেও বিড়ালের মতো লেজ গুটিয়েছি বার বার। তা লজ্জার নয়। কেননা, হাঁটা শেখার সময় বারবার আছাড় না খাওয়াটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু আমরা যে ক্রিকেট রণাঙ্গনে ক্রমশ প্রভাবশালীদের বলয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে পারছি, তা আমাদের গৌরব, আমাদের নৈপুণ্যের অর্জন। তিন বছর আগে এই অক্টোবরেই আমরা নিউজিল্যান্ডকে ৪-০ ব্যবধানে ধবল-ধোলাই করেছিলাম। এবারও পারবো নিশ্চয়ই। কিংবা যদি কোনোভাবে ফঁসকেও যায় দ্বিতীয় দফা বাংলাওয়াশ, বাংলাদেশ এ সিরিজের প্রথম দুটি ওডিআই ম্যাচ যে দাপটের সাথে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে, তা বুঝিয়ে দিয়েছে এ রাজসিক খেলার সাধারণ প্রজা আর আমরা থাকবো না। ক্রিকেটের প্রবল জনপ্রিয়তার আঁতুড়ঘর থেকে আমরা এখন পেয়েছি অসাধারণ তামিম, মাশরাফি, মুশফিক, সাকিব-সোহাগের মতো অসংখ্য ম্যাচজয়ী ক্রিকেটার। আমরা স্মরণ করতে চাই সেই দিনটিকে যেদিন আমরা প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করলাম, ১৯৯৯’র বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারালাম, অতঃপর মর্যাদা পেলাম টেস্ট ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের। মাত্র দেড় দশক আগে, ১৯৯৭ সালে যদি আইসিসি ট্রফিতে নাইরোবিতে ফাইনালে কেনিয়াকে পরাজিত করতে না পারতাম, এখন হয়তো এ ক্ষেত্রই তৈরি হতো না। ১৬ বছরে আমরা ৭০টি ওয়ানডে ম্যাচ জিতেছি, সে হিসেবে এটা দিয়ে সিরিজ জেতা হলো ১৮টি। সুতরাং প্রতিটি জয়ই আমাদের নতুন শৃঙ্গ নির্মাণের সোপান তৈরি করে দেয়।

 

রাজনৈতিক ডামাডোলের ঝড়ো হাওয়ায় যখন গোটা দেশ অস্থির তখন ক্রিকেট দল আশার প্রদীপ শিখা জ্বালিয়েছে, যখন বিমর্ষ-উত্কণ্ঠিত হচ্ছে দেশের আপামর মানুষ, তখন ক্রিকেটের দামাল ছেলেরা আমাদের মুখে হাসি ফুটাচ্ছে বটে। এ হাসি হয়তো নতুন জ্বালানি দেবে না ডামাডোলের আশার প্রদীপে; তারপরও জাতীয় গৌরব যখন আন্তর্জাতিকভাবে সমুজ্জ্বল হয়, তখন সকলের মনে এ বোধ জেগে তুলতে পারে বটে- আমরাও পারি। সে কারণেই সকল ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রতিটি সিরিজ জয় আমাদের উজ্জীবিত করে। সুতরাং সকল কিছু মিলে অদ্ভুত এক আঁধারের সময়ে এ ক্রিকেটের আলোকবর্তিকা আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে বটে। জয় হোক ক্রিকেটের।