উৎসাহ উদ্দীপনার বদলে উন্মাদনা পরিহারই শ্রেয়

 

ভালোই কাটলো একটি মাস। বাছাই পর্বে যোগ্যতার ভিত্তিতেই বিশ্বের বত্রিশটি দেশের জাতীয় দল বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেয়। বাছাইয়ে বাংলাদেশও অংশ নেয়। পারে না। ৪ বছর অন্তর আয়োজন করা হয়। এবার আয়োজক দেশ ছিলো ব্রাজিল। আসন্ন বিশ্বকাপের স্বাগতিক রাশিয়া।

ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবল বেশ কিছু শিক্ষা দিয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকার পড়শি দু দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। কালক্রমে দুটি দেশই ফুটবল পরাশক্তি। যদিও এবার শেষ চারে উঠে এসেও ব্রাজিলের খেই হারানো দশা বিশ্বজুড়ে তাদের সমর্থকদের হতাশ করেছে। করেছে ক্ষুব্ধও। প্রতিবেশীর সাথে যেমন ঘেঁষাঘেঁষি থাকে, তেমনই রেষারেষিও থাকে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মধ্যেও রয়েছে। তাদের ভিনদেশি সমর্থকদের মধ্যেও ঘেঁষাঘেঁষি রেষারেষির কমতি নেই। অফিসে, ঘরে-বাইরে, চা দোকানের বেঞ্চে দু দেশের সমর্থকদের যুক্তির ফোয়ারা উড়েছে। কে কোন দলের সমর্থক তার জানান দিতে উন্মাদনার শেষ থাকেনি। জমি বিক্রি করে পছন্দের দেশ জার্মানির পতাকা তৈরি করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিও কেড়েছে এই বাংলাদেশের এক সমর্থক। এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্তপর্বের রাতে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ সারাদেশেই উৎসবের আমেজ ফুটে ওঠে। পাড়ায় পাড়ায় বনভোজনেরও আয়োজন চলে। পছন্দের দলের পরাজয়ের কারণে কেউ যে তার ড্রয়িং রুমের টিভির দিকে রিমোর্ট ছোড়েনি তাও নয়। এসবই উন্মাদনার অংশ। যদিও খেলা দেখতে বসে পছন্দের দলের পরাজয় মেনে নিতে না পেরে কেউ যদি তার ড্রয়িং রুমের টিভিটা আছড়ে ভাঙে, তা হলে ক্ষতিটা তারই হয়। দল হেরেছে, সম্পদ ভাঙচুর করে কি ক্ষোভের আগুন নেভানো যায়? ওগুলো উন্মাদনা তথা অসুস্থ মানসিকতারই বহির্প্রকাশ। সেটা ঘরেই হোক, আর রাজপথেই হোক।

বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই পছন্দের দেশের জয় নিয়ে যুক্তি দেখানো, পরাজয়ে লজ্জায় মুখ লুকানো নয়। খেলায় জয়-পরাজয় থাকবেই। ভালোকে ভালো বলার মতো মানসিকতা গড়ে তুলে প্রতিটি খেলাকে উপভোগ করতে অবশ্যই উৎসাহ প্রয়োজন। ব্রাজিলের পরাজয়ে ব্রাজিলে কিছু উন্মাদ হিংসাত্মক কাজে মাতলেও খেলার মাঠে অধিকাংশ ব্রাজিল সমর্থক অনুকরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। যেদিন জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে পরাজিত হলো ব্রাজিল, সেদিন বয়স্ক এক ব্রাজিল সমর্থক সম্ভবত তিনি ব্রাজিলেরই নাগরিক। তিনি খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগলে রেখে ছিলেন ডামি গোল্ডকাপ। যখন খেলা শেষ, তখন তিনি ওটা আর ওইভাবে আগলে না রেখে তিনি জার্মানির এক সমর্থককে উপহার হিসেবে তুলে দিয়ে বলেন, ‘খেলা দেখে মনে হলো, এটা তোমাদেরই প্রাপ্য।’ চমৎকার! একইভাবে ব্রাজিল যেদিন ন্যাদারল্যান্ডের সাথে হারলো, সেদিনও ব্রাজিল সমর্থকরা পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানকে করতালির মধ্যদিয়ে উৎসবঘন করে নিজেদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলো। তা হলে যারা ভাঙচুর করেছে, আগুন ধরিয়েছে তারা কারা? ক্ষোভের আগুন! ফাইনালের পর প্রতিবেশী দেশ রানারআপ আর্জেন্টিনাতেও অভিন্ন চিত্র। এরকম উন্মাদনা নয়, খেলায় জয় পরাজয় মেনে নিতে হয়। যদিও গ্লানিটা থাকেই। তার গভীরতা উন্মাদনার মাত্রার ওপরই নির্ভর করে। পরাজয়ে দুমড়ে মুচড়ে না পড়ে সামনের দিনের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। আধুনিক ফুটবলেও লেগেছে বিজ্ঞানের ছোঁয়া। চরম চর্চা। অঙ্ক, চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভুল করলেই গ্লানি।

উৎসাহ উদ্দীপনা আর অতিউৎসাহে উন্মাদনা এক নয়। শব্দগুলোর উচ্চারণে আত্মীয়তা থাকলেও শব্দার্থে ফারাক ক্রোশ ক্রোশ। পছন্দের মোহে মাতলামি তথা ভালো মন্দের উপলব্ধিবোধ হ্রাস যেমন হিংস্র করে, তেমনই হীনতায়ও ভোগায়। ফলে উদ্দীপনার বদলে উন্মাদনা পরিহারই শ্রেয়।

পুনশ্চ: বাংলাদেশ কবেপারবে, কবে যাবে বিশ্বকাপ ফুটবলে?