১৭ দফা নির্দেশনা : বেতন-ভাতা বেড়েছে দুর্নীতি বন্ধ করুন

সচিবদের সথে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সচিবদের বাস্ত-বায়নের জন্য ১৭ দফা নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন ‘বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে এবার দুর্নীতি অপচয় বন্ধ করতে হবে’। সরকারের বর্তমান মেয়াদে সচিবদের সাথে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে গতকাল রোববার প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সভা কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন কমিশনকে উদ্ধৃত করে বলেন, আগামী বছরের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচন করবে বলে তারা চিন্তাভাবনা করছে। এ জন্য তিনি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে ২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী যাতে সকলে মিলে পালন করা যায় সে বিষয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করতে সচিবদের প্রতি আহ্বান জানান। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত মিত্র। বিশ্বের অনেক দেশে যুদ্ধ করতে গিয়ে মিত্র বাহিনী ফেরত যায়নি। বাংলাদেশ থেকে তারা ফিরে গিয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শন, ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজ নামচা’ সকলকে পড়ার আহবান জানান।

বৈঠকের শুরুতে আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলতে সরকারের সংস্কার কর্মসূচির উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম স্বাগত বক্তব্য দেন। অন্যান্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আব্দুল্লাহ আল মামুন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান সিনিয়র সচিব ড. নজিবুর রহমান, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ, স্বাস্থ্য সচিব সিরাজুল ইসলাম, আইএমইডির সচিব মফিজুল ইসলাম, মহিলা বিষয়ক সচিব নাসিমা বেগম, সেতু বিভাগের সচিব আনোয়ার হোসেন, সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের সচিব এমএন সিদ্দিক, শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইন,  জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ, সেবা ও সুরক্ষা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহমদে চৌধুরী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব শাহ কামাল, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জিল্লার রহমান, নৌ-পরিবহন সচিব অশোক মাধব রায়, পূর্ত সচিব মো, শহিদুল্লাহ খোন্দকার প্রমুখ বক্তব্য দেন।

সচিবদের পক্ষ থেকে চাকরির অবসরের বয়স বৃদ্ধি, সচিব হওয়ার ৩ বছর হলে সিনিয়র সচিব করা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাড়ানোতে স্থান সংকট দূর করা, আগারগাও-এ আধুনিক সচিবালয়ের মানচিত্র প্রদর্শন, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে ৩১ বছর, তাদের গাড়িতে বিশেষ মনোগ্রাম, সিনিয়র সচিব পদ বাড়ানো, আদালত অবমাননা মামলা পরিচালনায় বিশেষ তহবিল গঠন, সচিবরা অবসরে গেলেও বিমানবন্দরে ভিআইপি সুবিধা অব্যাহত রাখা এবং অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের নিয়ে একটি পুল গঠনের প্রস্তাব করেন। এসব সচিবদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোই হবে এ পুল গঠনের উদ্দেশ্য। বৈঠকে সারাক্ষণ চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস ও ব্যাংক খোলা রাখার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ উচ্ছেদে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জঙ্গিবাদ দমন এবং মাদক ব্যবসা বন্ধে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিন। এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বাগান সৃষ্টি করতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণে সকলকে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী ভূমি ব্যবহারের নীতিমালা ও জলাধার নীতিমালা সঠিকভাবে পরিপালনে সচিবদের নির্দেশ দেন।

প্রধানমন্ত্রীর ১৭ দফা নির্দেশনাগুলো হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পাহাড় ও টিলা অধ্যুষিত এলাকায় পরিবেশ রক্ষাসহ ভূমিধস প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন যাতে আর মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। স্থানান্তরিত হাজারিবাগের ট্যানারি কারখানাগুলোর জন্য যাতে সাভারের পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ।  বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৩৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ‘মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন, অংশীদারিত্বমূলক রাবার বাগান ও স্ট্রিপ বাগান সৃজন করা। গ্রাম উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে কর্মসংস্থান তৈরি করা যাতে গ্রামের মানুষ কাজের খোঁজে শহরে না আসে। শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ যাতে না বাড়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানো বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা।  উন্নয়ন কর্মসূচি এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ উপকৃত হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার আরও বাড়াতে হবে। অর্থবছরের শেষ দিকে তাড়াহুড়ো না করে বছরের শুরু থেকেই বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণে ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্ষা মৌসুমে প্রকল্পের পেপার ওয়ার্ক সম্পন্ন করতে হবে। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের প্রয়োজন হলে তা দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। পাশাপাশি কাজের গুণগতমানের সাথে কোন আপোষ করা যাবে না। ফাস্ট ট্রাক-ভুক্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে আরও আন্তরিক হতে হবে। দক্ষ এবং যোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিতে হবে। ভালো কাজের পুরস্কার আর মন্দ কাজের জন্য তিরস্কারের ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো থেকে সেবা পেতে জনগণকে যাতে ভোগান্তির শিকার না হতে হয় তার উদ্যোগ নিতে হবে। বেতনভাতা বাড়ানো হয়েছে কর্মচারিদের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করে সকলের ন্যায়-সঙ্গত পদোন্নতি এবং পদায়ন নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মকর্তা যারা দীর্ঘদিন চাকরি করবেন, প্রশিক্ষণে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। জঙ্গিবাদ দমন এবং মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এসডিজির সফল বাস্তবায়নে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং কেবল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নয়, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে জনকল্যাণে আত্মনিয়োগে সহকর্মীদেরও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

নাগরিকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি ওয়েবভিত্তিক অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা পরীক্ষামূলকভাবে চালুর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ সংশোধন করা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এবং জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন ২০১১ প্রণয়ণ করা হয়েছে। প্রণয়ণ করা হয়েছে জাতীয় শুদ্ধাচারের কৌশলপত্র।’

সচিবদের সরকারের অন্যতম চালিকাশক্তি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি রাজনৈতিক সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসে। কিন্তু সচিবদের আরও অনেক দীর্ঘ সময় ধরে সেবা দেয়ার সুযোগ থাকে। কাজেই এটা সচিবদের ওপরই নির্ভর করে, দেশ কীভাবে চলবে।’ শেখ হাসিনা সচিবদের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, তার দলের রাজনৈতিক দর্শন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি একটি ভালো টিমের সাথে কাজের সুযোগ পেয়েছেন।