সরকারি কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন

 

স্টাফ রিপোর্টার: সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে সরকার। বর্তমানে তা মূল্যায়ন করা হয় বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর) পদ্ধতির মাধ্যমে। এখন এই পদ্ধতির পরিবর্তে নতুন পদ্ধতি বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদন (এপিআর) চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। নতুন এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন হলে সারা বছরে একজন কর্মকর্তা কি কাজ করবেন বছর শুরু হওয়ার আগেই প্রত্যেক কর্মকর্তাকে তার সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে চুক্তি করতে হবে। কর্মকর্তাদের দক্ষতা অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠান কতোটুকু সফলতা অর্জন করেছে তাও মূল্যায়ন করা হবে। একজন কর্মকর্তা কোনো কাজে বেশি আগ্রহী, এজন্য তার কোন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন এর ওপর ভিত্তি করে পদোন্নতি ও পদায়ন করা হবে। এছাড়া বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি ও অর্থবছরের মতো কর্মকর্তাদের কর্মপরিকল্পনাও জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত গণনাসহ বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদনের (এপিআর) ফরমে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

জানা যায়, বর্তমানে বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর) পদ্ধতির মাধ্যমে মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু এসিআর পদ্ধতির বর্তমান এই ফরমের মাধ্যমে একজন কর্মকর্তার সব কার্যক্রম জানা যায় না। এই পদ্ধতির মাধ্যমে শুধু একজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যাবলি ও পেশাগত দক্ষতা সম্পর্কে জানা যায়। তাই বর্তমানে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন হলে একজন কর্মকর্তা সারা বছরে কি কাজ করেছেন সেটা বোঝা যাবে এবং বছর শেষে তা পর্যালোচনা করা হবে। এ ছাড়া যদি কোনো কাজ চুক্তি অনুযায়ী সম্পাদন না হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে সে কাজের জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে। এজন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. জহির উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদন ফরম পর্যালোচনাপূর্বক চূড়ান্তকরণ বিষয়ে একটি সভা আয়োজন করে। সেই সভায় কর্মকর্তাদের বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদনের (এপিআর) একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এর আগে খসড়া এই প্রতিবেদনের ফরম তৈরি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট (জিআইইউ)। তারা এই ফরম তৈরির পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছিলেন। সরকারি কর্মকর্তাদের ইনোভেশনমূলক কার্যক্রম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দেখভাল করায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জিআইইউর তৈরি করা ফরম জনপ্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সব অতিরিক্ত সচিবের সমন্বয়ে এক বৈঠকে এই প্রতিবেদন ফরমের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগির এ পদ্ধতির পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হবে। নতুন এ পদ্ধতি চালু হলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মেধা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার যথাযথ মূল্যায়ন হবে বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট (জিআইইউ)।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারি কর্মকর্তাদের বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদন (এপিআর) কয়েকটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে প্রত্যেক কর্মকর্তাকে তার সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে বছর শুরু হওয়ার আগেই যে চুক্তি হয়েছে তা পর্যালোচনা করা হবে। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার অধস্তন কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণ করবেন। এরপর প্রত্যেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফরম পূরণের মাধ্যমে জানাবেন তার অধস্তন কর্মকর্তাদের জন্য কি কি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তিনি কোন কাজে বেশি আগ্রহী। এসব অংশ প্রশিক্ষণ ও পদায়ন বিভাগে প্রেরণ করা হবে। তারা পর্যালোচনা করে সে অনুযায়ী প্রত্যেক কর্মকর্তার জন্য পদায়ন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। তৃতীয় অংশে বলা হয়েছে, শুধু কর্মকর্তাদের যোগ্যতা থাকলে হবে না, তিনি তার যোগ্যতা অনুযায়ী কি পরিমাণ কাজ করে প্রতিষ্ঠানের সফলতা অর্জন করেছেন সে জন্য প্রতিষ্ঠানের সফলতা ও ব্যর্থতাও বিবেচনা করা হবে। কর্মকর্তাদের মূল্যায়নের জন্য এপিআরের মোট ১০০ নম্বরকে তিনটি আলাদা অংশে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রত্যেকের কর্ম সম্পাদন/লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ৫০, পেশাগত দক্ষতার জন্য ২৫ ও ব্যক্তিগত গুণাবলির জন্য ২৫ নম্বর রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদন (এপিআর) তৈরির প্রাথমিক কমিটির সভাপতি মো. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন পদ্ধতিকে আরো বস্তুনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে বিদ্যমান এসিআরের পরিবর্তে এপিআর চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে। কারণ বিদ্যমান পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। প্রাথমিকভাবে দু-একটি মন্ত্রণালয়ে নতুন এই পদ্ধতির পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, জেলা ও উপজেলাসহ দেশের সব সরকারি দফতরে এ পদ্ধতি চালু করা হবে।

মো. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, এজন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিটের (জিআইইউ) সমন্বয়ে তৈরি করা কর্মকর্তাদের বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদনের (এপিআর) ফরম খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন এই খসড়া প্রতিবেদন সচিব কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। সচিব কমিটি অনুমোদন দিলে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করা হবে। তিনি আরো বলেন, এ পদ্ধতি চালু হলে প্রত্যেক সরকারি কর্মকর্তাকে বছরব্যাপী সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এতে সরকারি কার্যক্রমে একদিকে স্বচ্ছতা আসবে, অন্যদিকে জবাবদিহিতার আওতায় আসবেন কর্মকর্তারা। এপিআর পদ্ধতি চালু হলে উল্লেখযোগ্য কাজের খোঁজখবর প্রতিদিন নেয়া সম্ভব হবে।

গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট (জিআইইউ) মহাপরিচালক মো. আবদুল হালিম বলেন, আমরা ব্যাপক স্টাডি করে সরকারি কর্মকর্তাদের বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদন (এপিআর) ফরম তৈরি করেছি। এটা কার্যকর হলে প্রত্যেক কর্মকর্তার বার্ষিক কার্যক্রম স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। বিশেষ বিশেষ কাজসমূহের অগ্রগতি প্রতিদিন জানা যাবে। মো. আবদুল হালিম বলেন, জনগণের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সব ধরনের সেবাকে পরিমাপযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও জেলা পর্যন্ত এটি হয়েছে। শিগগিরই এটি ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। ব্যক্তিপর্যায়ে এ ধরনের চুক্তির বিষয়টি নিয়ে যেতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তির মূল্যায়ন করা হবে বার্ষিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে। সামগ্রিকভাবে পুরো দেশই এর আওতায় চলে আসবে। এতে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও সহজতর হবে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর, স্বায়ত্তশাসিত ও কর্পোরেশন মিলিয়ে বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৩৯৩ জন। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ১ লাখ ৪৮ হাজার ৮১৯ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৬৫ জন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৮ লাখ ৪০ হাজার এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রয়েছেন ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭২ জন।