সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার আবারও আলোচনায়

 

রাজনৈতিক দলে মতবিরোধ : দ্বিধায় ইসি : আজ ডেমো প্রদর্শন

স্টাফ রিপোর্টার: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার বিষয়টি আবারো আলোচনায় এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের মধ্যে নতুন প্রযুক্তির একটি ইভিএম তৈরি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সক্ষমতার দিক খতিয়ে দেখতে আজ বৃহস্পতিবার সেটির ডেমো প্রদর্শিত হবে। ইভিএম ব্যবহার নিয়ে প্রায় দশ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এর আগের দুটি কমিশনও ইভিএম ব্যবহার নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলো। আগামী সংসদ নির্বাচনে আদৌ ইভিএম ব্যবহার হবে কি-না, আংশিক না সম্পূর্ণ তা নিয়েও বর্তমান কমিশনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ইসির সংসদ নির্বাচনের খসড়া রোডম্যাপে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, কমিশনের সামনে ইভিএম উপস্থাপন করা হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে কিনা-তার সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন।

এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গঠিত হওয়ার পর থেকে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। ২০১০ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির মুখে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু ওইকেন্দ্রে ইভিএমের কারিগরি ক্রটি ধরা পড়ে। এ নিয়ে মামলাও হয়। ইভিএম নিয়ে সবচেয়ে বেশি জটিলতা হয় ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। জটিলতার কারণে ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে পুনরায় নির্বাচন আয়োজন করতে হয়েছিল ইসিকে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও একটি কেন্দ্রে ইভিএম বিকল হয়ে যায়। এসব কারণে ২০১৩ সালের পর থেকে আর কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়নি। সেই সময়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ১১শ ইভিএম তৈরি করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে এসে বিগত কাজী রকিবউদ্দীন মিশন আগের প্রযুক্তিটি বাদ দিয়ে নতুন প্রযুক্তির একটি ভোটিং মেশিন তৈরি করে, যার নাম দেয়া হয় ডিজিটাল ভোটিং মেশিন (ডিভিএম)। ওই মেশিনটি আজ কমিশনের সামনে উপস্থাপন করা হবে। এনআইডির সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহউদ্দিন নতুন ইভিএম প্রযুক্তির বিভিন্ন কারিগরি দিক তুলে ধরবেন।

জানা গেছে, নতুন এই পদ্ধতিতে শুধুমাত্র আঙুলের ছাপ সনাক্ত হওয়ার পরেই ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। এটি জাল ভোট ঠেকানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন। মেশিন ভেঙে ফেললেও বা পানিতে ডুবিয়ে দিলেও ব্ল্যাকবক্সের মাধ্যমে প্রদত্ত ভোটের হিসেব পাওয়া যাবে। এ প্রসঙ্গে এনআইডির সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহউদ্দিন জানান, বর্তমান যারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের আঙ্গুলের ছাপ রয়েছে। আঙ্গুলের ছাপ নিশ্চিত হওয়া ছাড়া কেউ ভোট দিতে পারবেন না। তিনি বলেন, আগের ইভিএমের বিভিন্ন ক্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণার পর এই নতুন ইভিএম তৈরি করা হয়েছে। তার দাবি, এটি হ্যাক করাও সম্ভব হবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের। ড. অ্যালেক্স হালডারমেন নামে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছিলেন, আমেরিকায় ইভিএম টেম্পারপ্রুফ নয়। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকায় ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোতেও তা নিষিদ্ধ হওয়ার পথে। পৃথিবীর শতকরা ৯০ ভাগ দেশে ই-ভোটিং পদ্ধতি নেই। যে কয়েকটি দেশ এটি চালু করেছিল তারাও এখন এটি নিষিদ্ধ করেছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল ভোট ইভিএমকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিমকোর্ট ৩টি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করে। নেদারল্যান্ডে ই-ভোটিং কার্যক্রমের প্রয়োগ হয়। তবে, জনগণের আপত্তির মুখে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় ডাচ সরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, জালিয়াতির সুযোগ থাকায় এতে এক চাপে ৫০টি ভোট দেয়া সম্ভব। বিদেশের মাটিতে বসেও ইভিএম হ্যাকিং করা যায় এবং একটি ইভিএম হ্যাকিং করতে এক মিনিটের বেশি লাগে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক -সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কোনো প্রযুক্তি গ্রহণের আগে তার ভালো-মন্দ দিকগুলো ভালো করে খতিয়ে দেখা উচিত। আর নির্বাচনের অন্যতম স্টেক হোল্ডার হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। যে প্রযুক্তি গ্রহণ করা হোক না কেন তা রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে তা করা উচিত।

বিএনপি ইভিএম বা ডিভিএম ব্যবহারের সরাসরি বিরোধিতা করছে। বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ভোট কারচুপির জন্য অনুগত কমিশন দিয়ে সরকার ইভিএম ব্যবহার করাচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ইভিএম ব্যবহার নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে ই-ভোটিং মেশিন ব্যবহারের দাবি জানিয়েছিলেন। নিবন্ধিত অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে।