শিক্ষা ব্যয়ে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস: খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদার বাজেট কাটছাঁট

 

স্টাফ রিপোর্টার: শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ খাতে সর্বোচ্চ বাজেট, উপবৃত্তি প্রদান, বিনামূল্যে বই বিতরণ, এবং স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা কার্যক্রম চালুসহ নানা সাফল্যে সরকার আত্মতুষ্টিতে ভুগলেও সন্তানের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকের এখন নাভিশ্বাস উঠেছে। টালমাটাল পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে অনেককেই খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদার বাজেট কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি উচ্চ ব্যয়ের সাথে তাল মেলাতে না পেরে কোনো কোনো অভিভাবক পরিবারের দু-একজন সদস্যের লেখাপড়ার পাট গুটিয়ে নিয়েছেন। এ অবস্থা চলমান থাকলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা।
এদিকে ভুক্তভোগীরা এজন্য সরকারের বাস্তবতা বিবর্জিত পদক্ষেপ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘বাগাড়ম্বর’ নীতিমালা এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের চরম প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দুর্নীতিকেই দায়ী করেছেন। তাদের ভাষ্য, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক পাওয়া গেলেও গাইড বই, কাগজ-কলম, খাতাসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে। বিষয়ভিত্তিক কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিউটর রাখতে গিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। এর ওপর স্কুলশিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর বায়না মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, শুধু বেসরকারি নয়, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত লেখাপড়া না হওয়ায় সেখানকার শিক্ষার্থীদেরও কোচিং সেন্টারে ছুটতে হচ্ছে। এ ছাড়া স্কুলশিক্ষকদের কাছে ব্যাচে না পড়লে পরীক্ষায় কম নাম্বার দেয়াসহ নানা হয়রানির হুমকি-ধামকি তো রয়েছেই।
প্রাইভেট ফার্মের মধ্যশ্রেণির কর্মকর্তা যুবায়ের হোসেন জানান, তার দুই সন্তান পড়ে মিরপুরের মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে। একজন পঞ্চম শ্রেণি ও আরেকজন দশম শ্রেণিতে। পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলেকে স্কুলের শ্রেণিকক্ষের বাইরে স্কুলে কর্তৃপক্ষের বাধ্যতামূলক কোচিংয়ে পড়াতে হয়। এর বাইরে একটি কোচিং সেন্টারে পড়ানোর জন্য মাসে দিতে হয় দুই হাজার টাকা। আর বড় ছেলেকে শ্রেণিকক্ষের বাধ্যতামূলক কোচিং ছাড়াও পাঁচটি বিষয়ে পাঁচজন শিক্ষকের কাছে পড়ার জন্য প্রতি বিষয়ে দেড় হাজার করে টাকা দিতে হচ্ছে। এর ওপর স্কুলের বেতন, খাতা, কলম-পেন্সিলসহ নানা শিক্ষা উপকরণ এবং স্কুল ও কোচিং সেন্টারে আসা-যাওয়ার পরিবহন খরচ ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। এ হিসাবে দুই সন্তানের শিক্ষাব্যয় মাসে ২২-২৩ হাজার টাকা। ব্যাংক কর্মকর্তা যুবায়ের হোসেন হতাশার সুরে বলেন, বেতনের টাকা দিয়ে সংসারের দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে শিক্ষা বাবদ এ বিশাল অঙ্কের অর্থের জোগান দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্তানরা আরো বড় ক্লাসে পড়লে এ খরচ আরো বাড়বে। এ অবস্থায় সঞ্চয় ভেঙে সন্তানদের কতদূর পড়াতে পারবেন তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
তার মতো একই সুরে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন সাউথ পয়েন্ট স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারহানা ইসলামের মা জাহানারা আনিকা। সদ্য স্বামীহারা এ ফ্যাশন ডিজাইনার জানান, মেয়েকে জেএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তুলতে বছরের শুরুতেই চার হাজার টাকা বেতন দিয়ে হাউস টিউটর রেখেছেন। এর ওপর স্কুলে ক্লাস শুরুর আগে এবং ছুটির পরে এক ঘণ্টা অতিরিক্ত পড়ানোর জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে দুই হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর জোগাড় করার জন্য স্থানীয় একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার সন্তানের শিক্ষাবাবদ খরচ ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। যা তার মতো মধ্যআয়ের মানুষের পক্ষে কতোদিন টেনে নেয়া সম্ভব হবে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন হতাশাগ্রস্ত ওই মা। অথচ ২০১২ সালের ২০ জুন স্কুলশিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য ও প্রাইভেট পড়ানো বন্ধে নীতিমালা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই নীতিমালা না মানলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জড়িত শিক্ষকের বেতনের সরকারি অংশ (এমপিও) বাতিল বা স্থগিত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি ও পাঠদানের অনুমতি বাতিল করার কথা উল্লেখ করা হয়।
অথচ এ নীতিমালা জারির পর কোচিং বাণিজ্য ও স্কুলশিক্ষকদের ব্যাচে ছাত্র পড়ানো বন্ধ হওয়া দূরে থাক, বরং তা আরো কয়েকগুণ বেড়েছে। যদিও এ জন্য দীর্ঘ চার বছরে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বাতিল হয়নি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বা পাঠদানের অনুমতি।
অভিভাবকদের অভিযোগ, এর মধ্যদিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাগাড়ম্বর ও প্রশাসনিক দুর্বলতা নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তবে কারো কারো দাবি, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের টপ টু বটম দুর্নীতিগ্রস্ত। কোচিংবাজ শিক্ষকদের কাছ থেকে তারা নিয়মিত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। আর এ কারণেই তারা চোখ বুঁজে রয়েছেন মন্তব্য করেন ওই অভিভাবকরা। যদিও অভিভাবক ফোরামের একাধিক নেতার অভিযোগ, সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার নামে শিক্ষা ব্যবস্থায় হযবরল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকার-ই শিক্ষার্থীদের গাইডবই ও কোচিংনির্ভর করে তুলেছে। যা শিক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে।  তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য, সমাজের উচ্চবিত্তদের গায়ে শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির অচড় সামান্যতমও পড়েনি। বিশেষ করে ধনিক শ্রেণির যেসব অভিভাবক তাদের সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছেন, তারা এ ধরনের কোনো সংকটেরই মুখোমুখি হতে হয়নি। এমনকি এ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অনেকে পুরোপুরি অন্ধকারে রয়েছেন।

গুলশানের বিআইটি (বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটরিয়াল) স্কুলের অভিভাবক বিলকিস ফাতেমা জানান, তার স্ট্যান্ডার্ড ফোরপড়ুয়া সন্তানের মাসিক শিক্ষাব্যয় গড়ে ১২/১৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে স্কুলের বেতন সাড়ে ৮ হাজার টাকা। বাকিটা শিক্ষা উপকরণ, টিফিন ও পরিবহন খরচ। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের পড়া বুঝিয়ে দিয়ে তা নিয়মিত আদায় করায় অধিকাংশ অভিভাবকই সন্তানের জন্য হাউস টিউটর দেন না। স্কুলশিক্ষকরা কোনো শিক্ষার্থীকে তাদের কাছে প্রাইভেট পড়তে চাপ দিয়েছেন এমন কথা কখনো কারো কাছ থেকে শোনেননি বলে জানান বিলকিস ফাতেমা। এদিকে মধ্যবিত্তের শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধির কথা সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অজানা থাকলেও এ শ্রেণির অভিভাবকরা তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এ নিয়ে তারা ক্ষোভে ফুঁসলেও স্রেফ সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে তা নীরবে হজম করছেন। তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কোনো কোনো অভিভাবক এ অবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে রাজপথে নামার কথা ভাবছেন। ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা জানান, সরকার শুধু স্কুলশিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য কিংবা গাইড বই ঠেকাতেই ব্যর্থ হয়নি; বরং শিক্ষা উপকরণের দাম নিয়ন্ত্রণেও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। এ কারণে কাগজ-কলম-পেন্সিল, সার্পনার-ইরেজার সবকিছুরই দাম বাড়ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এসব দ্রব্যের দাম ৪০-৫০ শতাংশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৮০ থেকে একশ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৬-৮ টাকার পেন্সিল ১০-১৫ টাকা, ৭০-৮০ টাকার রঙ পেন্সিল ১০০-১২০ টাকা, ৩০-৪০ টাকার পেন্সিলবক্স ৫০-৭০ টাকা, ৮-১০ টাকার এ-ফোর সাইজের খাতা ১২-২০ টাকা, ওয়াটার বেজড ৮-২০ টাকার জেলপেন ১০-৩০ টাকা, ৫-১০ টাকার ইরেজার ১০-২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এর সঙ্গে ফটোকপি ও বাইন্ডিং খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া শুধু কাগজের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশেরও বেশি। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে বেড়েছে বিদেশি বইয়ের দাম। ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ শিক্ষা উপকরণই দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়। মাত্র ২০ শতাংশ দেশীয়ভাবে জোগান দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে শিক্ষার উপকরণ কলমের ৭০ শতাংশ দেশি, বাকি ৩০ শতাংশ বিদেশি। অন্যদিকে পেন্সিল, ইরেজারের ৮০ শতাংশই বিদেশি। প্রতিটি পণ্য আমদানিতে উচ্চহারে শুল্ক দিতে হচ্ছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা বেশি দরে শিক্ষা উপকরণ বেচছে। শুল্ক হ্রাস করে এসব পণ্যের দাম সরকার অনায়াসেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারত বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘গণস্বাক্ষরতা অভিযানের’ একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক স্কুল সার্টিফিকেট (পিএসসি) বা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার খাতসমূহে মোট খরচের ৫৮ দমমিক ৭ ভাগই ব্যয় হয় প্রাইভেটে। আর ১৭ দশমিক ৪ ভাগ বিদ্যালয় আয়োজিত কোচিং এ ব্যয় হয়। ৩ দশমিক ২ ভাগ পরীক্ষাসংক্রান্ত যাতায়াতে, ২ দশমিক ১ ভাগ মডেল টেস্টে, ১ দশমিক ৯ ভাগ পরীক্ষার জন্য নিবন্ধনে, শূন্য দশমিক ৯ ভাগ কোচিং-প্রাইভেট পড়ার যাতায়াতে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিদ্যালয় আয়োজিত কোচিংয়ের তুলনায় প্রাইভেট পড়ার জন্য ব্যয়িত সময় ছিল কম; কিন্তু খরচের দিক থেকে প্রাইভেট পড়ার খরচ বিদ্যালয়ের কোচিংয়ের খরচের তুলনায় বেশি। অর্থাৎ বিদ্যালয় আয়োজিত কোচিংয়ের তুলনায় প্রাইভেটে ব্যয় হয় ৩ দশমিক ৪ গুণ। প্রতিবেদন তৈরিতে থাকা গবেষণা দলের প্রধান সমীর রঞ্জন নাথ বলেন, ২০০৯ সাল থেকে পিএসসি চালুর পর কোচিং যেমন বেড়েছে, তেমনি পরীক্ষাসংক্রান্ত শিক্ষা ব্যয় বড়েছে কয়েকগুণ। তিনি বলেন, ২০০০ সালে প্রাথমিক সমাপনীতে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিমূলক কোচিংয়ের শতকরা হার ছিল ৩৯ দশমিক ৪ ভাগ। গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ৮৬ দশমিক ৩ ভাগ। এই পরীক্ষায় এখন নাম্বার পাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। এই স্তরের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। পাশাপাশি নোট-গাইডবই পাঠ্যবইকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। শিশুরা শেখার আনন্দ ও সৃজনশীলতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।