মানুষশূন্য গ্রাম ঝিনাইদহের ‘মঙ্গলপুর’

 

 

শাহনেওয়াজ খান সুমন: মঙ্গলপুর একটি গ্রামের নাম। সরকারি কাগজপত্রে গ্রামটির অস্তিত্ব আছে, কিন্তু গ্রামে কোনো জনবসতি নেই। গ্রামটিতে এখন আর কোনো মানুষ বাস করে না। এক সময় এখানে মানুষের বসবাস ছিলো। এখনও বাড়ি-ঘরের চিহ্ন রয়েছে। আছে বড় বড় পুকুর। গ্রামটি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নে অবস্থিত।

পাশের গ্রামের মানুষের দাবি গ্রামটি ছিলো হিন্দুপ্রধান। আনুমানিক ৬০/৬৫ বছর পূর্বে এই মঙ্গলপুরে মহামারী আকারে কলেরা রোগ ছড়িয়ে পড়েছিলো। সে সময় গ্রামের অনেক মানুষ মারা যান। আতঙ্কে গ্রামের অনেকে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে আশ্রয় নেন। আর হিন্দু সম্প্রদায়েরা অনেকে বিনিময় করে ভারতে চলে যান। সর্বশেষ বসবাসকারী ব্যক্তি নেঠে ঠাকুর খুন হওয়ার পর গ্রামটি মানুষশূন্য হয়ে পড়েছে। গ্রামের জমি কেনাবেচা হয়ে অন্য গ্রামের মানুষের হাতে চলে গেছে।

এলাঙ্গী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তথ্যানুযায়ী মঙ্গলপুর গ্রামটি ৬৬নং মঙ্গলপুর মৌজায় অবস্থিত। ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানান, এই মৌজায় একটিই গ্রাম আছে। এই গ্রামে ২০৬টি খতিয়ানভুক্ত জমি রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাস জমি আছে ৫৯ শতক, ভিপি তালিকাভুক্ত জমি আছে ৫ একর ৭৭ শতক ও জনসাধারণের জমি আছে ২৫২ একর ১২ শতক। এছাড়া কাঁচা রাস্তা রয়েছে ২ একর ২ শতক জমির ওপর।

সরেজমিনে গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামটি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর, কালীগঞ্জ ও যশোরের চৌগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী। মূল গ্রাম মঙ্গলপুরটি কোটচাঁদপুর উপজেলার মধ্যে পড়েছে। কোটচাঁদপুর শহর থেকে চৌগাছা যাওয়ার পথে শিশুতলা বাজারের পাশেই এই গ্রামের অবস্থান। গ্রামটিতে কোনো মানুষ না থাকায় ভিটাবাড়ির জমিগুলো কৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে।

মঙ্গলপুরের বাসিন্দা ছিলেন কালীপদ মূখার্জী (৯২)। তিনি বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দাদপুরে থাকেন। কালীপদ জানান, মঙ্গলপুর গ্রামে বেশির ভাগ বসতি ছিলো তাদের সম্প্রদায়ের। শতাধিক পরিবার বাস করতো গ্রামটিতে। তিনি তখন খুব ছোট। গ্রামে কলেরা মহামারী আকার ধারণ করে। অনেক মানুষ মারা যায়। এ সময় গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে খাল-বিল আর পুকুর-ইন্দ্রার পানি নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে থাকলে সবাইকে মরতে হবে। এই প্রচারের পর গ্রামের মানুষ ভয়ে চলে যেতে শুরু করে। বেশির ভাগ বিনিময় করে ভারতে চলে যান। তারা কয়েকটি পরিবার পার্শ্ববর্তী বলাবাড়িয়া ও চাকলা গ্রামে আশ্রয় নেন। পরবর্তী সময়ে অন্যরাও চলে গেছেন ভারতে। তিনিই একমাত্র বলাবাড়িয়া গ্রামে রয়েছেন। তিনি জানান, নেঠে ঠাকুর তার মামা ছিলেন, তিনিই সবকিছু উপেক্ষা করে গ্রামে ছিলেন। আনুমানিক ২৫/৩০ বছর পূর্বে তিনি খুন হবার পর গ্রামে আর কেউ থাকলো না।

অবশ্য ভিন্ন কথাও শোনা গেছে। দাদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শামছুল হক জানান, হিন্দুদের পাশাপাশি কিছু মুসলমানও ছিলো গ্রামে। যারা অনেক পর্দার মধ্যে থাকতে পছন্দ করতো। তাদের বাড়িগুলো উঁচু পাঁচিল দেয়া থাকতো। ভেতর দেখা যেতো না। তিনি জানান, মুরব্বিদের কাছে শুনেছেন একজন ব্যক্তি কৌতূহলবশত গাছে উঠে বাড়ির ভেতর নজর দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মুসলমান পরিবারগুলো চলে যান। আর হিন্দুরা বিনিময় করে যান ভারতে। এভাবে গ্রামটি মানুষ শূন্য হয়েছে।

বলাবাড়িয়ার সুধান্য দাস (৭৫) জানান, তারা ছোট বেলায় ওই গ্রামে তাদের সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। সর্বশেষ নৃপেনন্দ্রনাথ ঠাকুর, হাজারী ঠাকুর ও নেঠে ঠাকুরকে দেখেছেন। নৃপেন ও হাজারী ভারতে চলে যাওয়ার পর থাকেন নেঠে ঠাকুর। তার কোনো সন্তান ছিলো না। ৩০ বছর আগে তিনিও খুন হন। গ্রামের জায়গা যারা চাষাবাদ করছেন তাদের একজন বলাবাড়িয়া গ্রামের ইমদাদুল হক। তিনি জানান, তারা ভারত থেকে এদেশে এসেছেন। গড়ান চন্দ্র নামের এক ব্যক্তির সাথে তারা বিনিময় করেন। এই মঙ্গলপুরে তার ২২ বিঘা জমি রয়েছে। একই গ্রামের ফজলুর রহমান জানান, তার ১৩ বিঘা জমি বিনিময় করে নেয়া আছে।

এ ব্যাপারে কোটচাঁদপুর উপজেলা নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ওই গ্রামে কোনো ভোটার না থাকায় তারা তালিকায় রাখেননি। এলাঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খাঁন জানান, তার ইউনিয়নে ১৬টি গ্রাম। যার মধ্যে মঙ্গলপুরও একটি। কোটচাঁদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবপ্রসাদ পাল জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে একটি গ্রাম মানুষ শূন্য হয়ে গেছে কী কারণে তা খুঁজে দেখা প্রয়োজন।