বেকার যুবকদের খুলে যেতে পারে সৌভাগ্যের দুয়ার

চুয়াডাঙ্গা জেলায় এই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে মৌচাষ : স্বল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফা

বখতিয়ার হোসেন বকুল : দামুড়হুদার সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম কুতুবপুর। ওই গ্রামেরই পশ্চিমপাড়ার শাহাবুদ্দিন সর্দারের একমাত্র ছেলে জানারুল ইসলাম (৩০)। অভাব অনটনের সংসারে পড়ালেখা বেশিদুর এগুতে পারেননি। জমিজমাও তেমন নেই বললেই চলে। দু বোনের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রী, একমাত্র মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস (৭) এবং মা-বাবা এ নিয়েই তাদের সংসার। সীমান্ত এলাকায় বসতবাড়ি হলেও অন্যের দেখাদেখি জানারুল কখনও চোরাচালানি কাজে জড়িয়ে পড়েননি। অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে কোনোমতে সংসার চালাতেন। প্রায় বছর দুয়েক আগে জানারুল বাড়ি থেকে রাগ করে চলে যান গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি উপজেলায়। ওখানে মাঠে সেচমেশিন চালানোর কাজ নেন। ওই কাশিয়ানিতেই পরিচয় হয় রাজশাহীর জুয়েল নামের এক মৌচাষির সাথে। তারই পরামর্শে জানারুল মাস পাঁচেক আগে গ্রামে ফিরে আসেন এবং ওই জুয়েলের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকার মৌচাষের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করেন। প্রায় আড়াই মাস ধরে তিনি গ্রামেরই সীমান্তের কোলঘেষে হুদাপাড়া মাঠে মৌচাষ শুরু করেন। গ্রামবাসি প্রথমে ঠাট্টা-মশকরা করলেও এখন তার পোয়াবারো। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার মধু বিক্রি করছেন তিনি। সংসারেও ফিরতে শুরু করেছে স্বচ্ছলতা।
দারুণ এ সফলতার বিষয়ে মৌচাষি জানারুল জানান, কাশিয়ানিতে জুয়েল ভাইয়ের মৌচাষ দেখে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। কিছু টাকা জোগাড় করে বাড়ি ফিরে আসি। পরে ওই জুয়েল ভাইয়ের সাথে রাজশাহী থেকে ৪০ হাজার টাকায় ৭ টি বক্স, মৌমাছিসহ ৩৫টি চাক এবং চাক থেকে মধু ছাড়ানো মেশিন কিনে নিয়ে আসি। পরে আমি একটি বক্স এবং ১০টি চাক বাড়িয়েছি। বর্তমানে মোট ৮টি বক্সে ৪৫টি চাক আছে। ২ মাসে প্রায় ১৩০ কেজির মতো মধু বিক্রি করেছি। প্রতি কেজি ৩শ’ টাকা করে বিক্রি করি। এলাকায় নির্ভেজাল মধুর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তাই বাড়ি থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। প্রতি সপ্তাহে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা থাকে। বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন কেনো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, অভাবের তাড়নায়। তিনি মুচকি হেসে আরও বললেন, যারা প্রথম প্রথম ঠাট্টা-মশকরা করতো এখন সেই সমস্ত লোকজনই বাড়ি থেকে মধু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আরও জানান, একটি বক্সে ১টি মাত্র রাণী মৌমাছি থাকে, আর পুরুষ মৌমাছি থাকে ৪-৫টি। বাকিরা সবাই শ্রমিক। তারা ফুল থেকে কষ সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকে। রাণী মৌমাছি না থাকলে চাকে মধু হবে না বলেও জানিয়েছেন মৌচাষি জানারুল।
দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য ও প: প: কর্মকর্তা ডা. আবু হেনা মোহাম্মদ জামাল শুভ জানান, মধু মহান সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত প্রাকৃতিক এন্টিবায়েটিক ওষুধ। যা সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যায়। মধু এমন একটি দামি এবং মূল্যবান ওষুধ যার গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। শিশুদের ঠা-া-কাশি সারাতে খুবই ভালো কাজ করে এই মধু। বড়দের ক্ষেত্রেও মধুর রয়েছে বিশেষ কিছু গুণাবলি। ওজন ও চর্বি কমাতে দারুণভাবে সহযোগিতা করে থাকে এবং দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে মধু খেলে ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে। চর্বি কমানোর মধ্য দিয়ে হার্ড ভালো থাকে। মধু ডায়াবেটিস রোগীরাও খেতে পারেন। কারণ এতে ডায়াবেটিস বাড়ে না। রবং ডায়াবেটিসের কারণে যারা চিনি খেতে পারেন না তারা মধু খাওয়ার মধ্য দিয়ে চিনির স্বাদটা পাবেন। এছাড়া চামড়ার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ত্বকের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে মধুর জুড়ি নেই।
দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি অফিসার সুফি মোহা: রফিকুজ্জামান বলেন, মৌমাছি ফুলে বসার মধ্যদিয়ে পরাগায়ন হয়। স্বাভাবিকভাবে একবিঘা জমিতে ৪-৫ মণ সরিষা হয়। মৌমাছি বেশি হলে প্রায় ২৫ ভাগ উৎপাদন বেড়ে যায়। চলতি মরসুমে উপজেলায় প্রায় আড়াইশ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। মৌচাষ করতে হলে বিচ্ছিন্নভাবে না করে কমিউনিটি আকারে সরিষার আবাদ করাটাই উত্তম। এতে উৎপাদনও ভালো হবে এবং মৌচাষ এগিয়ে নেয়াটা সহজ হবে। তিনি আরও বলেন, শুধু সরিষার মরসুমেই নয় সারা বছরই মৌচাষ করা যাবে। কারণ আমাদের দেশে সারা বছরই কোনো না কোনো ফুল থাকে। ফলে সরিষা শেষে আম বাগান, লীচু বাগানেও মৌচাষ করা যাবে। মৌচাষে বিনিয়োগের তুলনায় মুনাফা বেশি। কেউ যদি বাণিজ্যিকভাবে মৌচাষ করতে চান আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে প্রয়োজনীয় পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান মাও. আজিজুর রহমান বলেছেন, মধু আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত ওষুধ। পবিত্র কোরআনের মধ্যে সুরা বনী ঈসরাইলে মধু সর্বরোগের ওষুধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রিয় পাঠক, মধু সর্ম্পকে এলাকার এক প্রবীণ ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে শোনা গল্প আপনাদের জন্য তুলে ধরা হলো। একদিন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স:) রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। ওই সময় একদল মৌমাছি ওই পথ দিয়েই উড়ে যাচ্ছিলো। তিনি ওই মৌমাছির দলকে ডেকে বললেন তোমরা কোথায় যাও? মহাবনীর কথায় মৌমাছির দল থেমে গিয়ে উত্তর দিলো, হুজুর আমরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে যাচ্ছি। এবার মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স:) ওই মৌমাছির দলকে আবারও বললেন, আমার জানামতে তোমরা যখন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করো তখন তাতে এক ধরণের কষ-কষ বা তিতা ভাব থাকে। পরে তা মিষ্টি হয় কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মৌমাছির দল মহানবীকে বললো, হুজুর যখন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে ফিরে আসি তখন আমরা আপনার নামে জিকির করতে করতে আসি। আপনার জিকিরের বদৌলতেই তা মিষ্টি হয়ে যায়। লোকজন যে গুনগুন শব্দ শুনতে পাই সেটা ঠিক নয়, আমরা গুনগুন করি না। আমরা আপনার নামে জিকির করতে করতে আসি।