বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন : ইউএনও গ্রেফতারের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত : প্রশাসনে তোলপাড়

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃত করে কার্ড ছাপানোর অভিযোগে একজন ইউএনও গ্রেফতারের ঘটনায় খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত ছিলেন বিস্মিত। গতকাল বৃহস্পতিবার পত্র-পত্রিকায় এই খবর দেখে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্মকর্তারাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। ঘটনার পরপরই তারা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনেন। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ও প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিবিসি বাংলার রাতের অধিবেশন পরিক্রমায় মাসুদ হাসান খানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে একথা জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে সরাসরি দেয়া এই সাক্ষাৎকারে এইচ টি ইমাম বলেন, আমরা সবাই, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আজ যতো কর্মকর্তা ছিলেন, এটি দেখে আমরা সকলেই বিস্মিত হয়েছি। যে ব্যক্তি এই মামলা করেছেন, আমরা মনে করি তিনি অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ করেছেন। এইচটি ইমাম জানান, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে একজন ইউএনওকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার এই ছবিটি দেখান। এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে বলেন, ছবিটি দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ক্লাস ফাইভের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এই অফিসার সুন্দর একটি কাজ করেছেন এবং সেখানে যে ছবিটি আঁকা হয়েছে, সেটি আমার সামনেই আছে, আপনারা দেখতে পারেন এবং এই ছবিটিতে বিকৃত করার মতো কিছু করা হয়নি। এটি রীতিমতো পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। এই অফিসারটি রীতিমতো পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। আর সেখানে উল্টো আমরা তার সাথে এই করেছি, এই বলে প্রধানমন্ত্রী তিরস্কার করলেন। বললেন, এটি রীতিমতো নিন্দনীয়। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীকে কিভাবে গ্রেফতার করা হলো কোনোরকম অনুমোদন ছাড়া? এ প্রশ্নের উত্তরে এইচটি ইমাম বলেন, এটি করা যায় না। কারণ ইউএনও হচ্ছেন উপজেলা পর্যায়ে সরকারের সবচেয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাকে কোনো শাস্তি দিতে হলে বা তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা কোন রকম কিছু করতে হলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। এইচটি ইমাম এই ঘটনার জন্য বরিশালের ডিসি, এসপিকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, পুলিশ যে ব্যবহার করেছে এই ছেলেটির (ইউএনও) সঙ্গে, যেভাবে তাকে নিয়ে গেছে, এ নিয়ে আমি ওখানকার ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার, এদের প্রত্যেককে আমি দায়ী করবো। এদের বিরুদ্ধেও আমাদের বোধহয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিভাবে পুলিশ এরকম একটি মামলা নিলো আর জেলা জজই কিভাবে এই মামলা গ্রহণ করলেন, সেটা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।

এইচটি ইমাম বলেন, এই ঘটনায় মাঠপর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে তিনিও তাদের সঙ্গে একমত। আমাদের অফিসারটিকে যেন হেনস্থা করার জন্য পুলিশ যেভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে, এই পুরো ঘটনায় যেরকম তীব্র ক্ষোভ ফেটে উঠেছে, আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। এইচ টি ইমাম বলেন, ঘটনাটি শোনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, যে ব্যক্তি এই মামলা করেছে, সে কে? মামলা দায়েরকারী ব্যক্তি সম্পর্কে সাথে সাথে তারা খোঁজখবর নেন, একথা জানিয়ে এইচটি ইমাম বলেন, এই লোক পাঁচ বছর আগেও আওয়ামী লীগে ছিলো না। দলের ভেতরে ঢুকা পড়া এই অতি উৎসাহীরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, এই চাটুকাররাই আমাদের ক্ষতি করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এইচটি ইমাম বলেন, এই ঘটনার পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, এই অফিসারের বিরুদ্ধে হয়তো তাদের কোনো ক্ষোভ ছিলো। তাকে অপমানিত করা ছিলো তাদের লক্ষ্য। দ্বিতীয়ত বিভিন্ন সার্ভিসের মধ্যে একটি অসন্তোষ সৃষ্টি করা। আর তৃতীয়ত, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা।

দলের মধ্যেও ক্ষোভ: এ ঘটনা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং দলটির সমমনাদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। দলটির সমমনাদের অনেকে বলেছেন, এক শ্রেণির চাটুকার বিভিন্ন সময়ই এ ধরনের মামলা করে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে। অনেকে আবার বলেছেন, শেখ মুজিবের নাম ব্যবহার করে অতিউৎসাহী অনেক ব্যক্তি এবং অনেক ভূঁইফোড় সংগঠনের কর্মকাণ্ড তাদের দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। বরিশালে আওয়ামী লীগের একজন নেতা এবং সেই জেলার আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়েদ উল্লাহ সাজু আদালতে মামলাটি করেন গত ৭ই জুন। তাতে অভিযোগ করা হয়েছে, জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলায় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের আমত্রণপত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃত করে ছাপা হয়েছে।  অভিযুক্ত করা হয়েছে আগৈলঝাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তারিক সালমানকে। তিনি বরগুনা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা। মামলার শুনানিতে বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত প্রথমে ওই নির্বাহী কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত বুধবার এই নির্দেশ দেয়ার দুই ঘণ্টা পর আদালত তাকে জামিন দেয়। একটি শিশুর আঁকা ছবি আমন্ত্রণপত্রে ব্যবহার করা হয়েছিলো। মামলার বাদির বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তার পক্ষের আইনজীবী এবং সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম খোকন বলছিলেন, কার্ডের উপরে এবং ভিতরে বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবি নাই। কার্ডের পিছনে একবারে নিচে ছবি ছাপা হয়েছে। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অবজ্ঞা করা হয়েছে বলে আমরা মনে হয়েছে। সে কারণে আমরা মামলা করেছি। বরিশালে এমন মামলা করার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা চলছে। আওয়ামী লীগেরই সমমনাদের অনেকে সামাজিক নেটওয়ার্কে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরছেন। তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মী এবং গণজাগরণ মঞ্চের একজন সংগঠক কামাল পাশা চৌধুরী বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ছবিটা এঁকেছে একটা শিশু। একটা শিশুর ছবি যে স্বাভাবিকভাবে রিয়েলিস্টিক ছবি হয়না, এই ধারণাটাই তাদের নেই। এর সাথে চাটুকারিতার মিশ্রণে তারা এই মামলা করেছে। কামাল পাশা চৌধুরী আরও বলেছেন, সারাদেশে এ ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এই দলকে, নেত্রীকে এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনরকম চাটুকারিতা করা যায় কি না। এই অতিউৎসাহীদের শুধু দল থেকেই নয়, সমাজ থেকেই এদের বিতাড়িত করা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও অনেকে এই মামলার বিষয়কে ভালভাবে নেননি। দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন, এখন মামলার পিছনে অতি উৎসাহ কাজ করেছে। আবার দলটির অনেকে বলেছেন, শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে অতি উৎসাহী এবং ৫০টির মতো সংগঠন কাজ করে থাকে। এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বিভিন্ন সময় দলে আলোচনা হলেও তাদের থামানো যাচ্ছে না। এ নিয়ে দলের ভেতর ক্ষোভও রয়েছে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বিবিসিকে বলেছেন, একটি শিশু তার কল্পনা শক্তি দিয়ে অনেক কিছু করতে পারে বা ভুল করতে পারে। কিন্তু একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা শিশুর আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভুল করতে পারেন না। এদিকে সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান মনে করেন, অতি উৎসাহ থেকে বরিশালে মামলাটি হয়েছে এবং সেটি আওয়ামী লীগেরই ক্ষতি করছে।