বহু প্রতীক্ষিত গঙ্গা ব্যারেজ আবার আলোচনায়

 

স্টাফ রিপোর্টার: রাজবাড়ি জেলার পাংশায় নির্মিত হবে বহুল প্রতীক্ষিত গঙ্গা ব্যারাজ। গঙ্গা অববাহিকার পানি সংরক্ষণ করে তা দেশের কৃষিসহ বহুমুখী কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে এই ব্যারাজ নির্মিত হতে যাচ্ছে। গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পটিকে গুরুত্ব না দিলেও গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ আর মাত্র ১০ বছর বাকি থাকায় সরকার এ ব্যারাজ নির্মাণে উদ্যাগী হয়ে উঠেছে। কেননা, ব্যারাজ নির্মাণে ৭ বছরের বেশি সময় লাগবে। তাই সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায় স্থান পেয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্প।

এ ব্যারাজের সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখতে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ব্যারাজ নির্মাণের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়। এ ব্যারাজ নির্মাণে ভারতের সাথে আলোচনা করে কাজ করছে সরকার। তাছাড়া অর্থায়নের জন্য জাপান ও চীনের সাথেও আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এ মাসের শেষ সপ্তাহে কিংবা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঙ্গা ব্যারাজের প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখতে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা আসবে বলে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

এ ব্যারাজ নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতু নির্মাণের খরচের পরে এ প্রকল্পের অর্থ সংস্থানের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে সরকার। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঢাকা সফরের সময় গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পটি অন্যতম আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছিলো। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় গঙ্গা ব্যারাজসহ কয়েকটি প্রকল্পের বিষয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাই গঙ্গা ব্যারাজে জাপানের অর্থায়নের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। এদিকে গঙ্গা ব্যারাজে অর্থায়নে চীনও আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

এ প্রকল্পের আওতায় ১১৭ মেগাওয়াট উত্পাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ব্যারাজের ওপর যে ব্রিজ করা হবে, সেখান থেকে টোল আদায় করা হবে। এ দুটি থেকেই মোট বিনিয়োগের এক-চতুর্থাংশ ফেরত আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এছাড়া প্রায় ১৭টি জেলায় কৃষি ও সেচের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা থেকেই উঠে আসবে বাকি বিনিয়োগ।

সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ শুরু হয়। নানা জটিলতার পর ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালে সমীক্ষার কাজ শেষ হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ১৭টি জেলা (যা দেশের মোট এলাকার ৩৭ শতাংশ) গঙ্গার পানির ওপর নির্ভরশীল। দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এ অঞ্চলে বসবাস করে। কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধিকল্পে ১৯৭৫ সালে গঙ্গা নদীতে প্রায় আড়াই কিলোমিটার লম্বা ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করা হলে শুষ্ক মরসুমে বাংলাদেশের  অভ্যন্তরে গঙ্গার পানিপ্রবাহ হ্রাস পেতে থাকে। ফলে এই ১৭টি জেলার কৃষি, মত্স্যচাষ, বন, নৌ চলাচল এবং নদীর পানির স্বল্পতার জন্য পলি অপসারণে সমস্যা দেখা দেয়। একই সাথে এ অঞ্চলে নদীতে সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে পড়ছে এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এ এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে গঙ্গা নদীর ওপর একটি ব্যারাজ নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) প্রাক্তন মহাপরিচালক ড. এমএ কাশেম বলেন, ১৯৫৯ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তির পর ১৯৬২-৬৩ সালেই গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়ে প্রথম জরিপ হয়। পরে ১৯৬৮-৬৯ সালে আরেকটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়ে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। ১৯৯৬ সালে ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা পানি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর সরকার গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়।

ব্যারেজ নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ বৃহত্তর কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পাবনা এবং রাজশাহী বিভাগের ৭টি জেলার ১৯ লাখ হেক্টর কৃষিজমির সেচের পানি সুনিশ্চিত হবে। একই সাথে নিশ্চিত হবে বর্ষা মরসুমে প্রবাহিত পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মরসুমে পানি প্রবাহ ধরে রাখা, মত্স্য সম্পদ সংরক্ষণ ও প্রসার।

বহুমুখী এ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে ২ কিলোমিটার ও প্রস্থ হবে ১৮ মিটার। এতে থাকবে বর্ষা মরসুমের পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার। আরো থাকবে নেভিগেশেন লক, স্লুইস গেট, ২৫ মিটার করে দুটি ফিশ পাস গেট, ব্রিজ, রেলওয়ে ও গ্যাস পাইপ লাইন। মূল ব্যারেজ নির্মাণ করতে ৩ বছর লাগলেও পুরো প্রকল্প শেষ হতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লাগবে।