প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পথিকৃৎ শহীদ টগরের আত্মোৎস্বর্গের স্মৃতিতে শহরে ভাস্কর্য নির্মাণ এখন সময়ে দাবি

রহমান মুকুল: যাদের বীরত্বগাথা আর গৌরবময় ইতিহাস শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, তাদের অন্যতম খন্দকার জামসেদ নূরী টগর। টগর নামেই তিনি অধিক পরিচিত। ছেলেবেলায় আমাদের নিকট তিনি ছিলেন রূপকথার ডালিম কুমার। তার বীরত্বগাথায় কিশোর বয়সেই একদিকে যেমন বুকের বিস্তার বেড়ে যেতো, অন্যদিকে যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর তার পবিত্র লাশ নিয়ে রাজাকারদের লজ্জাজনক ও চুড়ান্ত বর্বরোচিত আচরণ মনে গভীর ক্ষোভ আর যারপরনাই ঘৃণার জন্ম দিতো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সে এক জলদগম্ভীর ট্রাজিক ঘটনা।
আলমডাঙ্গা পৌরসভার গোবিন্দপুর গ্রামের মরহুম খন্দকার নূর উদ্দিনের জৈষ্ঠ ছেলে ছিলেন খন্দকার জামসেদ নূরী টগর। অত্যন্ত ভদ্র ও সবল দেহের অধিকারী ছিলেন। চুয়াডাঙ্গা কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। অধ্যয়নরত ছিলেন খুলনা সিটি কলেজে এলএলবি। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছাত্র সমাজের ১১ দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিলো তার। যুদ্ধের সময় ভারতে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের ভেতর সশস্ত্র যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে হয়ে উঠেন জাদরেল যোদ্ধা।
১৩ আগষ্ট ১৯৭১ দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক করুণতম বেদনামথিত দিন। তার আগের দিন আলমডাঙ্গা এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা এন্টি ব্যাংকার মাইন দিয়ে আলমডাঙ্গা-হালসার মাঝে রাতে পাক সৈন্যের টহল ট্রেন উড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। এ ঘটনায় মন খারাপ করে মুক্তিযোদ্ধারা পার্শ্ববর্তী মিরপুর উপজেলার চকহারদী (মেকুরপুর) গ্রামের শেষ প্রান্তে লালান মন্ডলের বাড়িতে অবস্থান নেন। পরদিন অর্থাৎ ১৪ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে সকালের নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সকলে। এমন সময় জনৈক গ্রামবাসী দৌঁড়ে গিয়ে হাপাতে হাপাতে সংবাদ দিলেন পাক সৈন্য শুকচা গ্রামের পূর্বদিক থেকে বাজিতপুর গ্রামের দিকে আসছে। খাওয়া হলো না মুক্তিযোদ্ধাদের! মুক্তিযোদ্ধা কমা-ার আব্দুল হান্নান পরামর্শ করে নিলেন বন্ধু জামসেদ নূরী টগরের সাথে। তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন পাক সৈন্যের মোকাবেলার। পাক সৈন্য যে পথে বাজিতপুর- শুকচা গ্রামে প্রবেশ করেছিলো, সে পথে তারা অ্যাম্বুস করেন। এই একই পথে ফিরে যাওয়া ছাড়া পাক বাহিনীর গত্যন্তর ছিলো না। শুকচা গ্রামের দিকে ক্যানেল। ক্যানেলের পূর্বদিকে ইটভাটা, ইটভাটার সামনে পানিতে টইটম্বুর কুমার নদ। মুক্তিযোদ্ধারা ক্যানেলের পশ্চিম পাশে অ্যাম্বুস করেন। এ সময় পাকবাহিনী বাজিতপুর গ্রামে প্রবেশ করে বাড়ীঘরে আগুন লাগায়। গ্রামবাসীর ছাগল-হাঁস-মুরগি ধরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। সকাল ন’টার দিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নামে। এই ইলশেগুড়ি বৃষ্টির মধ্যেই বিরাট পাকবাহিনী ছাগল-হাঁস-মুরগি নিয়ে পূর্বোক্ত রাস্তায় ফিরছিলো। ইটভাটা বরাবর আসলেই মুক্তিবাহিনীর অ্যাম্বুসে পড়ে যায় তারা। প্রথম আক্রমণেই ২জন পাক সৈন্য নিহত হয়। দ্রুত পজিশন নিতে গিয়ে বেশ কয়েকজন কুমার নদের পানিতে পড়ে যায়। সাঁতার না জানার ফলে তারা ডুবে মরে। বাকী পাক সৈন্য ইটভাটার মধ্যে অবস্থান নেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের লাইট মেশিনগান নষ্ট হয়ে যায়। ফায়ার হয় না। এমন বিপদজ্জনক পর্যায়ে পাকবাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিত ধরার চেষ্টা করে। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার করতে করতে উত্তর দিকে পিছু হটতে থাকেন। রবিউল নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যানেলের পানিতে রাইফেল ছুড়ে দিয়ে সাঁতরিয়ে ওপারে সুতাইল গ্রামে গিয়ে উঠেন। সকলেই এক পর্যায়ে পার হয়ে গেলেও কমা-ার আব্দুল হান্নান ও জামসেদ নূরী টগর পেছনে পড়ে যান। আব্দুল হান্নানের নিকট শুধু বিকল লাইট মেশিনগান ছিলো। ফায়ার করার ভয় দেখিয়ে তিনি উত্তর দিকে দৌঁড় দিচ্ছিলেন। পাক সৈন্য ইতোমধ্যেই তাদের বেশ নিকটবর্তী হয়েছে। খুব বেশি নিকট থেকে তারা গুলি চালাচ্ছিলো। পাকবাহিনীর মুহুর্মুহু গুলি টগরের মাথার পাশ দিয়ে, দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে, বগলের নীচ দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। তিনি বিভিন্ন কৌশলে কখনও শুয়ে পড়ে, কখনও রোলিং করে, দৌঁড়ে গুলি থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ! হঠাৎ একটা গুলি তার মাথায় লাগে, তিনি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এভাবেই বীরত্বের সাথে শত্রুর মোকাবেলা করেন একজন দেশপ্রেমিক। শহীদ হওয়ার ঘটনা বলতে গিয়ে তার খালাতো বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা কমা-ার অ্যাড. আব্দুর রশিদ মোল্লা অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, টগর শহীদ হওয়ার কিছুদিন পূর্বে তারা একই সাথে ভারতের শিকারপুর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। দেশে ফেরার দিন খেতে বসে ও (টগর) বায়না ধরলো “ভাই, তুমি আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দাও। এখন আমার মনে হয়, ও বাঁচবে না বলেই হইতো এমন বায়না তুলেছিলো।”
টগরের নিষ্প্রাণ দেহ শুকচা গ্রামের ক্যানেলের পাশে পড়েছিলো। সে সময় সুতাইল গ্রাম থেকে মুজিববাহিনী কমা-ার কাজী কামাল উড়ো ফায়ার শুরু করলে পাক সৈন্য আর সামনে যেতে সাহস দেখায়নি। তারপরের ঘটনা যতোটা বেদনা বিধুর, ততোধিক ট্রাজিক। তারচে’ অধিক কাপুরুষত্বের। পাকসৈন্য টগরের প্রাণহীন দেহ গরুর গাড়ির পেছনে বেঁধে টানতে টানতে আলমডাঙ্গা শহরে নিয়ে আসে। আলমডাঙ্গা শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা গরুর গাড়িতে বাঁশ দিয়ে শহীদ টগরের লাশ ঝুলিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। সেই সাথে ব্যান্ডপার্টি নিয়ে পৈশাচিক আনন্দযজ্ঞে মেতে ওঠে। শেষে লাশটি সকলের প্রদর্শনের জন্য চারতলার মোড়ে ৩দিন ধরে টেলিফোনের বীমের সাথে ঝুলিয়ে রাখে। শান্তিবাহিনী ও রাজাকাররা টগরের পিতাকে লাশ শনাক্ত করতে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। তিনি বুকফাটা যন্ত্রনা সত্ত্বেও রাজাকার ও শান্তি বাহিনীর নির্লজ্জ উম্মাদনা দেখে ভয়ে লাশটি তার নিজের ছেলের নয় বলে জানিয়েছিলেন। ইতিহাসে এমন বর্বরোচিত ঘটনা বিরল! আদরের বড় ছেলে; তাকে দেশের নামজাদা উকিল করতে চেয়েছিলেন পিতা। এমন ছেলের লাশ অস্বীকার করার যন্ত্রনা হয়তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে তাড়া করে ফিরেছিলো। পরে শহীদ টগরের লাশ শহরের পূর্বদিকে মরহুম মহররম বিহারীর বাড়ি বরাবর ক্যানেলে মাটিচাপা দিয়ে রাখে বর্বর কুলাঙ্গার রাজাকাররা।
দেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম। এ স্বাধীনতার মহান স্থপতিদের অন্যতম খন্দকার জামসেদ নূরী টগর। সেভাবেই তাকে এখনও স্মরণ করে থাকে আলমডাঙ্গার স্বাধীনতাত্তোর প্রজন্ম। এ প্রজন্ম তাকে চোখে দেখেনি বটে। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য বীরত্বপূর্ণ অবদান, তার আত্মোৎস্বর্গের জীবন্ত কাহিনি এখনও নতুন প্রজন্ম মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। ভবিষ্যত প্রজন্মের নিকটও তিনি স্বপ্নের ডালিম কুমার হয়ে বেঁচে থাকবেন। আর শান্তিবাহিনী-রাজাকারের নাম মীরজাফরের নামের সাথে সমধিক ঘৃণায় উচ্চারিত হবে। এ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীর যথার্থ মর্যাদা প্রদানের জন্য শহরে কোন ভাস্কর্য আজোবধি নির্মাণ করা হয়নি। এ অকৃতজ্ঞতার দায় বহনে কি আমাদের মাথা নত হয় না?