পাঁচ দিনের মধ্যে প্লাবিত হবে দক্ষিণাঞ্চল !

 

২১ জেলার ৩৫৬ উপজেলার ৩৫৮ ইউনিয়ন প্লাবিত : মৃতের সংখ্যা ৩৩

স্টাফ রিপোর্টার: ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায় নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারি হিসেবে ২০ জেলার ৩৫৬ উপজেলার ৩৫৮ ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যার কবলে সোমবার মৃত্যু হয়েছে আরও ১৪ জনের। এ নিয়ে বন্যায় মোট মৃতের সংখ্যা দাড়িয়েছে ৩৩ জনে। সোমবার মৃত্যু হওয়া ১৪ জনের মধ্যে দিনাজপুরে পাঁচজন, কুড়িগ্রামে সাতজন ও লালমনিরহাটে ২ জন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, প্রধান নদনদীগুলোয় পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন সোমবার জানান, নদনদীগুলোর ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের ৬৯টিতে পানি বাড়ছে। এর মধ্যে ২৭টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপরে বয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং সুরমা-কুশিয়ারায় সমান তালে পানি বেড়ে যাচ্ছে।

এর মধ্যে ধরলা, তিস্তা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধলেশ্বরী, গুর, ইছ-যমুনা, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, আত্রাই, পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, যদুকাটা, সোমেশ্বরী ও কংস নদীতে পানি বিপদসীমার ওপরে বইছে।
বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা প্রকাশ করে এ কর্মকর্তা বলেন, যমুনার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে সোমবার বিকেল ৩টায় পানির উচ্চতা ছিলো বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার ওপরে যা এ পয়েন্টের রেকর্ড। এর আগে গত বছর বিপদসীমার ১২১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঠেছিলো। এছাড়া কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ ও সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনা নদী বিপদসীমার ৯৬-১০০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে। গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মাও বিপদসীমা ছাড়িয়েছে; এখন ১৬ সেন্টিমিটার ওপরে। আর যমুনেশ্বরী বদরগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার এবং কংস নদী জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে বিপদসীমার ১৮১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। আগামী কয়েকদিনে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বন্যার বিস্তার বাড়বে বলে আভাস দেন সাজ্জাদ হোসেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলছেন, দেশের উজানে তিনটি অববাহিকায় (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা) গত দুতিন দিন ধরে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। ফলে এসব অববাহিকার ভারতীয় ও বাংলাদেশ অংশের নদীগুলোতে পানি বাড়ছে।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনকে প্রস্তুতি নিতে বলেছে অধিদফতর। পানি বৃদ্ধির হার অন্তত আরও ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে জানিয়ে তাদের বলা হয়েছে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট জেলায় চলমান বন্যা গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হবে। পাশাপাশি মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হতে পারে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদফতরের সোমবারের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে আরও দুদিন। বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমতে পারে বলে আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম জানিয়েছেন। তিনি জানান, সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে টাঙ্গাইলে ৮৫ মিলিমিটার। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসেরও আশঙ্কা থাকে।
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর: দিনাজপুর: জেলার বিভিন্ন এলাকায় নয়টি বাঁধ ভেঙে গেছে। নদীতে পানি কমলেও এর ফলে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকেছে। প্লাবিত হয়েছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী কর্মকর্তা মো. সিদ্দিকুজ্জামান জানান, রোববার পুনর্ভবা নদীতে পানির উচ্চতা ছিল ৩৮ দশমিক ৩১ মিটার। সোমবার এই নদীতে পানির উচ্চতা ৩৮ দশমিক ২৮ মিটার। আত্রাই নদীতে পানির উচ্চতা রোববার ছিলো ৪০ দশমিক ১৫ মিটার। সোমবার কমে হয়েছে ৪০ দশমিক ১০ মিটার।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোখলেসার রহমান বলেন, বন্যার পানিতে দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে রেললাইন ডুবে গেছে। এজন্য দিনাজপুরের সাথে সারাদেশের রেল যোগাযোগ গতকাল থেকে বন্ধ রয়েছে। এছাড়া দিনাজপুর সদর উপজেলায় বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গতকাল সকালে একজন মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক খায়রুল আলম। তার পরিচয় জানা যায়নি। গত দুদিনে দিনাজপুর সদর, খানসামা, বিরল, বীরগঞ্জ ও কাহারোল উপজেলায় বন্যায় ১৩ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে তিন দিনে ১৪ জনের মৃত্যু হলো।

লালমনিরহাট: লালমনিরহাট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান জানান, গতকাল দুপুর দুইটার দিকে সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের পূর্ববড়ুয়া গ্রামে রবিউল ইসলামের সাড়ে তিন বছরের ছেলে নাজিম, নাজিমের মা নাজমা বেগম (২২), রবিউলের বোনের স্বামী মোজাম্মেল হক (৪৫) ও মোজাম্মেলের সাত বছরের ছেলে আলী হোসেন বন্যার পানি পার হয়ে আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে সবাই পানিতে তলিয়ে যায়। এক ঘণ্টা পর শিশু নাজিমের লাশ ভেসে ওঠে। বাকিরা নিখোঁজ রয়েছেন।
লালমনিরহাটের পাউবো বলছে, গতকাল সকাল ৬টার দিকে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে, তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
লালমনিরহাট রেল বিভাগীয় সূত্র জানায়, বন্যার পানিতে লালমনিরহাট-বুড়িমারী রুটের ভোটমারী থেকে বুড়িমারী পর্যন্ত, কুড়িগ্রামের রমনা বাজার থেকে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত, ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড় রুট, লালমনিরহাট রেলস্টেশন থেকে তিস্তা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও ত্রাণ কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানান, বন্যায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি।
ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেবেন্দ্রনাথ জানান, ওই উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গতকাল সকালে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৬৮ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া ইউনিয়নে দুধকুমার নদের পানি ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ী, রাজারহাটের কালুয়া ও ফুলবাড়ীর গোড়কম-ল এলাকায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সড়ক ভেঙে যাওয়ায় এবং পানি ওঠায় জেলার সঙ্গে এসব এলাকার সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

বগুড়া: জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শাহারুল হোসেন মোহাম্মদ আবু হেনা সোমবার সকালে বলেন, গত রাতে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে যমুনা নদীতে ৩০ সেন্টিমিটার ও বাঙালি নদীতে অস্বাভাবিক পানি বেড়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, যমুনায় পানি বেড়ে যাওয়ায় উপজেলার চন্দনবাইশা, কামালপুর, কুতুবপুর, বোহাইল, কর্নিবাড়ী, চালুয়াবাড়ী, হাটশেরপুর, কাজলা, সারিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শুধু সারিয়াকান্দি উপজেলাতেই পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা অর্ধলাখে ছাড়িয়ে যেতে পারে। স্রোতের তোড়ে চরাঞ্চলে নদীভাঙনে চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের মানিকদাইর চর ও বহুলাডাঙ্গা চরের অর্ধশত পরিবার গৃহহারা হয়ে পড়েছে।
বগুড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আমিন বলেন, গত ৪৮ ঘণ্টায় যমুনা নদীর মথুরাপাড়া পয়েন্টে ৯৭ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে এখন বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনায় পানি যেভাবে ধেয়ে আসছে তাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি এবং গত জুলাই মাসের বন্যার চেয়েও পরিস্থিতি দ্বিগুণ খারাপ হতে পারে।

রংপুর: উজান থেকে ধেয়ে আসা পানি ও কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে রংপুরের ছয় উপজেলার ৩০ ইউনিয়নের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিনটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলায় সাতটি ইউনিয়নে ৫০টি গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কাউনিয়া উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পীরগাছার ২০টি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত অন্য উপজেলাগুলো হলো পীরগাছা, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ ও পীরগঞ্জ। পানিতে ডুবে গেছে রোপণকৃত আমন ক্ষেতসহ বিভিন্ন রবি ফসল।

জামালপুর: যমুনা নদীর পানি বেড়ে জামালপুরের চারটি উপজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। জামালপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পানি পরিমাপের নিয়ন্ত্রক আব্দুল মান্নান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যেভাবে পানি বাড়ছে দ্রুত সময়ের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। জামালপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাসেল সাবরিন বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী দুর্গত এলাকায় পেঁৗছানোর কাজ চলছে।
গাইবান্ধা: দফায় দফায় বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সুরক্ষা কাজে সহযোগিতা করছে সেনাবাহিনী। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয় বলছে, আজ সোমবার দুপুর ১২টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টে ৬৪ সেন্টিমিটার, করতোয়া নদীর পানি গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার ও তিস্তা নদীর পানি সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফুলছড়ি উপজেলা।
নীলফামারী: জেলার বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরেও বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। ধসে পড়েছে বিমানবন্দরের সীমানা দেয়াল। এদিকে বন্যার পানিতে কলার ভেলা থেকে পড়ে বেলাল হোসেন (১৬) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার দুপুরে সদর উপজেলার কচুকাটা ইউনিয়নের দুহুলী শান্তিনগর এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে। নিহত বেলাল সেখানকার জামাল উদ্দিনের ছেলে। ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে সদস্য আবদুল হাই জানান, এলাকাটি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কয়েকজন বন্ধু মিলে কলার ভেলায় ঘুরছিল তারা। একপর্যায়ে ভেলাটি বিদ্যুতের পোলের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে ছিটকে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় বেলাল।
সুনামগঞ্জ: জেলার দোয়ারাবাচার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের আজবপুর গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে মৃদুল মিয়া (৪) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বিকাল ৩টার দিকে উপজেলার আজবপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। শিশু মৃদুল উপজেলার আজবপুর গ্রামের আবদুল জব্বারের ছেলে। দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ইদ্রিছ আলী বীরপ্রতীক জানান, আব্দুর জব্বারে বাড়িটি বন্যাকবলিত। বসতঘরের চতুর্দিকে বন্যার পানি থৈ থৈ করছে। সোমবার বিকাল ৩টার দিকে শিশু মৃদুল পরিবারের সবার অগোচরে বন্যার পানিতে পড়ে যায়। স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন। বিশেষ করে গজলডোবাসহ ভারতীয় অংশের বাঁধগুলো খুলে দেয়ায় বন্যা পরিস্থিতি বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে ভারতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চল পেরিয়ে নতুন করে প্লাবিত হবে দক্ষিণাঞ্চলও। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) বলছে, আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে যশোর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, চাঁদপুর, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লারও কিছু কিছু অংশ প্লাবিত হবে। এফএফডব্লিউসি�র পর্যবেক্ষণাধীন ৯০ স্টেশনের মধ্যে সে সময় ৩৭টি পয়েন্টে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপদসীমার অনেক ওপরে থাকবে। তবে ১২টি পয়েন্টে পানি কমার প্রবণতায় থাকবে। এই ১২ পয়েন্টের মধ্যে আবার ১০টি পয়েন্টের পানিও বিপদসীমার অনেক ওপরে থাকবে। সে হিসেবে বন্যা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতির লক্ষণ নেই। আত্রাইয়ের পানি আত্রাইয়ে বিপদসীমার ১৪৫ সেন্টিমিটার, সিংড়ায় ৭১ সেন্টিমিটার, করতোয়া-আত্রাই-ঘাঘটের পানি বাঘাবাড়িতে ১১২ সেন্টিমিটার, আর নওগাঁয় ছোট যমুনার পানি ৬১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে।
ঘাঘটের পানি গাইবান্ধায় বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার, ধরলার পানি কুড়িগ্রামে ৭৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারীতে বিপদসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার, যমুনার পানি বাহাদুরাবাদে ১৪৩ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিতে ১১৯ সেন্টিমিটার, কাজীপুরে ১৯২ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জে ১৭৫ সেন্টিমিটার, পোড়াবাড়িতে ৫৯ সেন্টিমিটার এবং আরিচায় ১১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। পুরাতন ধলেশ্বরীর পানি জগিরে বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার, ধলেশ্বরীর পানি কালাগাছিয়ায় ১১৭ সেন্টিমিটার, কালিগঙ্গার পানি তারাঘাটে ৬৯ সেন্টিমিটার ও টঙ্গি খালের পানি টঙ্গিতে বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে।
বুড়িগঙ্গার পানি ঢাকার হরিহরপুরে বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার, বালু নদীর পানি ডেমরায় ১২ সেন্টিমিটার, শীতলক্ষ্যার পানি নারায়ণগঞ্জে ২৭ সেন্টিমিটার, লাখপুরে ১০৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে।
ধলেশ্বরির পানি এলাশিনঘাটে বিপদসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার, মুন্সীগঞ্জে ৮৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে।
তালবাড়িয়ায় গঙ্গার পানি বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার এবং পদ্মার পানি গোয়ালন্দে ১৩৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। পদ্মার পানি ভাগ্যকুলে বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার ও মাওয়ায় ১৪২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। গড়াইয়ের পানি কামারখালিতে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার, সুরেশ্বরে পদ্মার পানি বিপদসীমার ৫১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। সুরমার পানি সিলেটে বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জে ৮৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। কুশিয়ারার পানি শেওলায় বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার, শেরপুর-সিলেটে ৬ সেন্টিমিটার, দিরাইয়ে ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। এদিকে মেঘনার পানি নরসিংদীতে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার, বাইদের বাজারে ৮৭ সেন্টিমিটার, মেঘনা ব্রিজে ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে।
দেশের অভ্যন্তরে বৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদী ভরাট থাকায় পাহাড়ি ঢলের পানি ব্যাপক বন্যা সৃষ্টি করবে। ফলে নতুন করে প্লাবিত হবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোও। এ ক্ষেত্রে পানি সাগরে নেমে যেতে বিলম্ব হলে বন্যা গত জুলাইয়ের চেয়ে কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমানে ২০টির মতো জেলায় প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়ে দেশের ৩৩ জেলা আক্রান্ত হওয়ার কথা ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে দেশের ওপর মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় গত কয়েকদিন ধরে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পৌনে ৬ লাখ মানুষ এদিকে চলতি মৌসুমের দ্বিতীয় দফার বন্যায় এ পর্যন্ত ২০ জেলার পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৩৯০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া জানিয়েছেন। এসব এলাকার তিন লাখ ৬৮ হাজার ৫৮৬ জন মানুষকে ৯৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বন্যার সবশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, উজানের দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানে মারাত্মক বন্যার বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে। আমরা উজানের দেশের বন্যা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখছি। উজানের দেশগুলোতে বন্যা হলে ভাটির দেশ হিসেবে উজানের প্রভাব আমাদের উপর পড়বে_ এটাই স্বাভাবিক।’
মন্ত্রী জানান, সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিসহ ২০ জেলার ৩৫৬টি উপজেলার ৩৫৮টি ইউনিয়ন দ্বিতীয় দফার এই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী আরও বলেন, ‘উত্তরাঞ্চল থেকে পানি নামার সময় মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, চাঁদপুর, রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও ভোলা জেলা প্লাবিত হতে পারে। পানি এলে ঢাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনাও আমরা দেখছি। তিনি জানান, দুর্গত হয়েছে এবং হতে পারে এমন ৩৩টি জেলায় ১০ হাজার ৬৩০ টন চাল ও তিন কোটি ১০ লাখ টাকা ইতোমধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় রোববার মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) এবং সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে তাদের কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেসব অঞ্চলে ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে সেসব এলাকার সংসদ সদস্যরা ইতোমধ্যে এলাকায় চলে গেছেন এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয় সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। কোথায় কী প্রয়োজন সেভাবেই আমরা চাহিদা মেটাচ্ছি। মায়া বলেন, বন্যার এই দুর্যোগ মাসখানেক স্থায়ী হতে পারে এবং শেষ না হওয়ায় পর্যন্ত সরকারের তৎপরতা চলবে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের হাতে খাদ্যের কোনো অভাব নেই, পর্যাপ্ত খাবার আছে। এ ধরনের পরিস্থিতির (বন্যা) সম্ভাবনা বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে শুরু করেছেন এবং ইতোমধ্যে আসা শুরু হয়েছে। খাদ্যাভাব হবে বলে আমার মনে হয় না। আমরা সেটা মোকাবেলা করতে পারব।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলেন, উদ্ধারকারী যানবাহন ও নৌকা আগে থেকেই প্রস্তুত রাখতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জিআরের টাকা দিয়ে নৌকা কিনতে বলা হয়েছে। কয়েক জায়গায় উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, বিজিবি এবং সেনা বাহিনীর সহায়তাও নেয়া হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষ বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত যাতে খাবার ও অন্যান্য সহযোগিতা পান সে ব্যবস্থাও নেয়ার কথা বলেন রিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে ৫ থেকে ৭ লাখ টন খাদ্যশস্য আনার প্রক্রিয়া চলছে আরও খাদ্যশস্য আনা হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মন্ত্রীর সঙ্গে এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।