ড. জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা : হামলাকারী আটক

স্টাফ রিপোর্টার: বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ছুরি হাতে তাকে হত্যার চেষ্টা করে এক তরুণ। তার মাথায়, পিঠে ও হাতে ছুরিকাঘাত করা হয়। আকস্মিক এ হামলার পরপরই হামলাকারী তরুণকে ধরে ফেলেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তাকে বেদম মারধর করা হয়। তাত্ক্ষণিকভাবে অধ্যাপক জাফর ইকবালকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তার অস্ত্রোপচার হয়। তার অবস্থা শঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন সেখানকার চিকিত্সকরা।

পরে রাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে উন্নত চিকিত্সার জন্য তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আইএসপিআর’র পরিচালক লে. কর্নেল রাশিদুল হক জানান, ড. জাফর ইকবালকে রাত ১২টার দিকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে চিকিত্সকরা পর্যবেক্ষণ করছেন। ৫ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। রাতে আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী ড. জাফর ইকবালকে দেখতে হাসপাতালে যান বলে জানা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, হামলার পর হাসপাতালে নেয়ার সময় মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হলেও কথা বলছিলেন ৬৪ বছর বয়সী এই অধ্যাপক। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহাবুবুল হক জানিয়েছেন, ড. জাফর ইকবালের মাথার পেছনে দুটি এবং পিঠে ও বাম হাতে একটি করে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তিনি আরও জানান, রাত ৯.৫০ মিনিটে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।

এদিকে ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ভিড় জমে প্রশাসন-পুলিশের ঊর্ধতন কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষের। এই ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে শাবি ক্যাম্পাসসহ সিলেট নগরী উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ফটকের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক বন্ধ করে দেয়। সেখানে সব ধরণের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিবাদ মিছিল বের হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। জালালাবাদ থানার ওসি শফিকুল ইসলাম স্বপন বলেন, ‘ক্যাম্পাসে উত্তপ্ত অবস্থা চলছে। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ভাঙচুর করছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।’

জাফর ইকবালের ওপর হামলার সঠিক কারণ জানা যায়নি। জঙ্গিদের হামলার অন্যতম লক্ষ্য জাফর ইকবাল কয়েক বছর ধরেই পুলিশ পাহারা পেয়ে আসছেন। তিনি বরাবরই জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। কয়েক বছর আগে লেখক, অধ্যাপক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের উপর জঙ্গি হামলার সময় জাফর ইকবালও হুমকি পেয়েছিলেন। তখন তার পাহারায় পুলিশ মোতায়েন করে সরকার।

গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক জাফর ইকবাল। সেখানেই তার ওপর হামলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী এক শিক্ষার্থী জানান, বিকেল ৫টার দিকে জাফর ইকবাল স্যার মঞ্চে ওঠার সময় হালকা দাড়ির এক তরুণ পেছন থেকে অতর্কিতে এসে তার মাথা ও ঘাড়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে ওই তরুণকে বেদম পেটানোর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন-২ এ আটকে রাখা হয়। পরে তাকে পুলিশ হেফাজতে দেয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মঞ্চের পেছন থেকে এসে এক ছেলে ছুরি মারে গলা, বুক ও মুখের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশসহ অন্যরা তাকে আটক করে।’ ঘটনাস্থলে উপস্থিত নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটির কমিপউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নওশাদ সজীব জানান, দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতের পর পরই ড. জাফর ইকবাল উঠে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আই এম অলরাইট, তোমরা উত্তেজিত হয়ো না।’ এ কথা বলার সাথে সাথেই তিনি বসে পড়েন। এ সময় তার মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে মুখ ও শার্ট ভিজে যায়।

পুলিশের উপস্থিতিতে হামলা: অধ্যাপক জাফর ইকবাল যখন অনুষ্ঠানে ছিলেন তখন পুলিশ পাহারা ছিলো। কিন্তু তারপরও ছাত্রের বেশে দাড়িওয়ালা প্যান্ট পড়া ২৫ বছরের হামলাকারী তরুণটি তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো। অনেকেই বুঝতে পারেনি সে ছাত্র না অন্য কেউ। হঠাত করেই সে জাফর ইকবালের উপর হামলা চালায়। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, সেখানে আরো এক হামলাকারী ছিল। সে নাকি মোটরসাইকেলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

হাসপাতালে রক্ত দিতে ভিড়: প্রিয় শিক্ষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে রক্ত দিতে গতকাল ওসমানী হাসপাতালে ভিড় জমান শিক্ষার্থীরা। তাদের অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে ৮ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করা হয়। ছুরিকাঘাতের কারণে তার ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. মুর্শেদ আহমদ রাত ৯টায় ওটি থেকে জানান, এর মধ্যে ৩ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে তাকে। নিউরোসার্জন ডা. রাশেদুন্নবী তার মাথায় অস্ত্রোপচার করেছেন। তিনি শঙ্কামুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছেন তিনি।

ড. জাফর ইকবালকে দেখতে রাতেই হাসপাতালে যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি আহত শিক্ষকের চিকিত্সার খোঁজ-খবর নেন। এছাড়া বিভাগীয় কমিশনার, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ তাকে হাসপাতালে দেখতে যান।

মশাল মিছিল-প্রতিবাদ সমাবেশ: আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাতের প্রতিবাদে মশাল মিছিল করেছে গণজাগরণ মঞ্চের নেতাকর্মীরা। গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে রাজধানী শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে এক প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে তারা এই মিছিল বের করে। একই স্থানে আজ রোববার হামলাকারীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করবে।

বিক্ষোভ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন-গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার, শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবিন আহসান, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি জিলানী শুভ, সাবেক সভাপতি লিটন নন্দীসহ বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

সমাবেশে ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, প্রগতিশীল আন্দোলন নস্যাত্’র অংশ হিসেবে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়েছে। সরকার এই হামলার দায় এড়াতে পারে না। কারণ পূর্বে যখন বিভিন্ন প্রগতিশীল মানুষের ওপর হামলা হয়েছে, সরকার হামলাকারীদের বিচার না করে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এই দেশে আমরা কেউই নিরাপদ নই।