চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশ এলাকায় চলছে খেজুরগাছ তোলার তোড়জোড়

নিপা ভাইরাস : বাদুরের কবল থেকে রক্ষার তাগিদ

 

নজরুল ইসলাম/কামরুজ্জামান বেল্টু/ শরিফ শান্ত : শীত মরসুম এলেই মনে পড়ে যায় খেজুরের রস আর নানা রকম পিঠার কথা। শীতকালে খেজুর রস ও গুড় দিয়ে তৈরি করা হয় মজাদার সব পিঠা-পায়েস। বছর ঘুরে কার্তিক মাস এলেই শুরু হয় খেজুর গাছ তোলার তোড়জোড়। গাছিরা চেষ্টায় থাকেন কে আগে গুড়-পাটালি বানিয়ে বাজারে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু চুয়াডাঙ্গাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কার্তিকের প্রথম দিকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় বৃষ্টির আশঙ্কায় গাছিরা গাছ তুলতে ভয় পান। খেজুরের রস খুবই সুস্বাদু ও লোভনীয় হওয়ায় সবারই ইচ্ছে জাগে শীতের কোনো না কোনো সময় রস বা রস দিয়ে তৈরি কোনো পিঠা পায়েস খেতে। কিন্তু আশঙ্কার ব্যাপার হলো নিপা ভাইরাস। সম্প্রতি নিপা ভাইরাস নিয়ে শঙ্কিত সারা দেশের মানুষ। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ নিপা ভাইরাস আতঙ্কে ভুগছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত বছরে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে পাঁচজন। বাদুরের লালা থেকে এ ভাইরাস সংক্রমিত হয়। খেজুর গাছের যে স্থান থেকে রস নির্গত হয় (নলি) সেখানে বাদুর বসে রস পান করলে তা যদি রসের ভাঁড়ে পড়ে তা থেকে মানুষের দেহে এ ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই বিশেষভাবে ভাঁড়ে ঢাকনা বা ঝাপ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে বাদুর বসে রস পান করতে না পারে। কারণ একমাত্র বাদুর ছাড়া কোনো প্রাণী নিপা ভাইরাস বহন করে না। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে মালয়েশিয়ায় এ ভাইরাসে মানুষ সংক্রমিত হওয়ার কথা জানা যায়। আতঙ্কের কথা হলো, বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে নিপা ভাইরাস আতঙ্ক নেই। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে অজানা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা গেলে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। বছর তিনেক পর ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত হয় এটি নিপা ভাইরাস। তাই এ ভাইরাস থেকে নিরাপদে থাকার জন্য অবশ্যই গাছিদেরকে গাছের নালিতে ঢাকনা বা সরপার ঝাঁপ দিয়ে ভাঁড়ের মুখ ঢেকে দিতে হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে। তবে তারা মনে করেন, আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া উচিত। অর্থাৎ নিপা ভাইরাসের কারণ ও ধরণ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার কথা বলেছেন তারা। কারণ নিপা ভাইরাসে আক্রান্তদের শতকরা ৮০ জনেরই মৃত্যু হয়। বিগত কয়েক বছর থেকে শীত মরসুমে এ ভাইরাসের প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটি সূত্র জানায়, বিগত ৮ বছরে বাংলাদেশে নিপা ভাইরাসে ১৭৬ জন আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ১৩৬ জন মারা যান। রাজধানী ঢাকায় ৮ বছরের একটি শিশু এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, নওগাঁ, নাটোর ও গাইন্ধায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত ৬ জনের মধ্যে ৫ জনেরই মৃত্যু হয়। বলাই বাহুল্য জরুরি ভিত্তিতে এ ভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এ মৃত্যুর সারি লম্বা হতে বেশি সময় লাগবে না। সাধারণত জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

নিপা ভাইরাস প্রসঙ্গে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেজ্ঞ ডা. পরিতোষ কুমার ঘোষ ও ডা. বেলাল হোসেন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানান, নিপা ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৮ থেকে ১২ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। প্রাথমিকভাবে লক্ষণগুলো জ্বর, মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, দুর্বলতা, বমিরভাব, গলাব্যথা, কাশি, শ্বাস কষ্ট ইত্যাদি। তবে রোগের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে জীবাণু কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। তখন তীব্র জ্বরের সাথে রোগী অচেতন হয়ে পড়ে, খিচুনি হয়, প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয় অতঃপর কোমায় চলে যায়। এভাবে এক পর্যায়ে রোগীর মৃত্যুর ঘটে। নিপা ভাইরাস প্যারামিক্সো পরিবারের সদস্য। রাসায়নিক গঠনের দিক থেকে এটি এক ধরনের ‘আর এন এ’ ভাইরাস। প্রাণী দেহে বাস করে বলে একে জুনোটিক ভাইরাসও বলে। নিপা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় মালয়েশিয়ার পেনিনসুলায় ১৯৯৮ সালে শুকরের শরীর থেকে। ধারণা করা হয় এর উদ্ভব ঘটেছে আরো আগে সম্ভবত ১৯৯৪ সালে। তবে পরবর্তীতে সিঙ্গাপুর ও ভারতেও রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ২০০১ সালে। নিপা ভাইরাস ছড়ায় মূলত বাদুরের মাধ্যমে। মানুষ, কুকুর, বিড়াল প্রভৃতি এর মধ্যবর্তী পর্যায়।

এদিকে নিপা ভাইরাস প্রতিরোধে জনসাধারণকে ৫টি বিষয়ে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব পরামর্শের মধ্যে রয়েছে খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়া, কোনো ধরনের আংশিক খাওয়া ফল না খাওয়া, ফলমূল পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে খেতে হবে, আক্রান্ত হলে রোগীকে যতদ্রুত সম্ভব নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে এবং আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসার পর সাবান এবং পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। আবার নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে খেজুর গুড় ও রস, আখের রস, পেঁপে, পেয়ারা, বরইয়ের মতো ফলও না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কেউ খেজুরের রস পান করতে চাইলে যেন অবশ্যই রস গরম করে স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে পান করেন। ৭০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রাতে নিপা ভাইরাসের কার্যকারিতা নষ্ট হয়।