চুক্তি না হলেও ট্রানজিটের সব সুবিধা নিচ্ছে ভারত

স্টাফ রিপোর্টার: আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি না হলেও ট্রানজিটের সব সুবিধা নিচ্ছে ভারত। পরীক্ষামূলক ও নৌ-ট্রানজিটের নামে ভারত এদেশের বিভিন্ন বন্দর ব্যবহার করছে। কৌশলে ভারত এদেশের ভূখ- ব্যবহার করায় বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মক হুমকিতে পড়ছে। আবার বন্দর ব্যবহারে প্রাপ্য অর্থও ঠিকভাবে পরিশোধ করছে না ভারত। ট্রানজিটের আদলে বাংলাদশের ভূখণ্ড ব্যবহার করলেও প্রাপ্তির খাতা শূন্যই থেকে যাচ্ছে।

সূত্রমতে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন করতে ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট সুবিধা চাচ্ছে। বিশেষ করে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ট্রানজিট নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। এ নিয়ে খোদ সরকারের মধ্যে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। অনেক সমালোচনার পর একপর্যায়ে সরকার ট্রানজিট চুক্তি করা থেকে বিরত হয়। কিন্তু ট্রানজিট চুক্তি না হওয়ায় আপাতত অন্য একটি চুক্তির আওতায় ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে নির্দিষ্ট নৌপথ অনুসরণ করে উত্তরপূর্বে কয়েকটি জায়গায় পণ্য নিচ্ছে। এছাড়া মানবিক কারণ দেখিয়ে আশুগঞ্জ ও আখাউড়া স্থলবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ।

জানা গেছে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৪০ হাজার টন চাল, চিনি ও গম ত্রিপুরায় নেবে ভারত। এতে ভারতের পরিবহন খরচ বাঁচবে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা। ট্রানজিটের অংশ হিসেবে এ খাদ্যশস্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরায় নেয়া হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য নিয়ে আসার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ। কোলকাতার হলদিয়া বন্দর থেকে চাল, চিনি ও গমের চালান নিয়ে জাহাজ এসে বাংলাদেশের আশুগঞ্জ নদী বন্দরে ভিড়বে। সেখান থেকে পণ্য খালাস করে তা সড়ক পথে ত্রিপুরায় যাবে।

জানা গেছে, ২০১২ সালেও বাংলাদেশ-ভারত নৌ-প্রটোকল চুক্তির আওতায় ফি বাবদ বছরে ১০ কোটি টাকা প্রদানের জন্য ভারতকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ভারত এ প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। বর্তমানে ভারত ফি বাবদ সাড়ে ৫ কোটি টাকা দিচ্ছে। কিন্তু সেটাও ঠিক সময়ে পরিশোধ করছে না। ফলে ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের পরে প্রাপ্তির খাতা শূন্যই থেকে যাচ্ছে।  সূত্র জানায়, ২০১৪ সাল থেকে আগরতলা হতে আখাউড়া হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হবে। আখাউড়া থেকে সীমান্ত পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হবে ২০১৩ সালের চলতি মাসে। তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ করে আগামী বছরের প্রথম দিকেই পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু করতে চায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এর আগে এ বছরই দুই দেশের মধ্যে রেল ট্রানজিট চুক্তি হবে। ট্রেন পরিচালনা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পরিবহন মাশুলসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো তখনই নির্ধারিত হবে। এদিকে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর সমান্তরাল পৃথক রেল সেতু নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। দেশের উত্তরাঞ্চলে এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে স্বল্প ব্যয়ে দ্রুত পণ্য পরিবহনের জন্যই এই সেতু নির্মাণ করা হবে বলে জানা যায়।

ভারতকে এ পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, মানবিক দিক বিবেচনা করে ভারতকে তারা শর্তসাপেক্ষে এ অনুমোদন দিয়েছেন। ভারত বলেছে, তারা এদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ত্রিপুরার জনগণের জন্য খাদ্যপণ্য সরবরাহ করবে। প্রতিবেশী হিসেবে বিষয়টি মানবিকভাবে দেখেছেন এবং অনুমতি দিয়েছেন। জানা গেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনোমহন সিং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফর করেন। বিরোধী দলের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ওই সফরেই ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিলো। একই সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিও হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তিতে বাদসাধেন। এ কারণে ট্রানজিট চুক্তিও হয়নি। প্রসঙ্গত, খসড়া চুক্তিতে ট্রানজিট চালুর জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে খরচ হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর ট্রাক প্রতি ৫০ ডলার আয় হওয়ার কথা ছিলো। চার দেশের মধ্যে মোট ১৫টি ট্রানজিট রুট চালুর প্রস্তাব ছিলো। এর মধ্যে সড়ক পথে ৭টি, রেল পথে ৬টি এবং নৌপথে ২টি ট্রানজিট রুট হওয়ার কথা ছিলো।

এদিকে, ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির বিষয়ে কোনো সুরাহা না হলেও শিগগিরই ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি হবে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের বলেন, ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বাণিজ্য সম্প্রসারণে চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহার করতে ভুটান আগ্রহী। নেপালকে ট্রানজিট দেয়ার ব্যাপারেও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাংলাদেশ। কিন্তু নেপালকে ট্রানজিট দিতে হলে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে হবে। তাদের ট্রানজিট দিতে হলে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের একযোগে চুক্তি হতে হবে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির বিষয়টা ঝুলে যাওয়ায় নেপাল-ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিটের বিষয়টাও আটকে গেছে। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, দেশের বিদ্যমান অবকাঠামো ট্রানজিটের জন্য উপযুক্ত নয়। তবে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে ট্রানজিট দরকার। আর ট্রানজিটের জন্য দরকার অবকাঠামো উন্নয়ন। ১৯৪৭ সাল থেকেই ভারতের সঙ্গে এ ভূখণ্ডের তা আছে। মাঝখানে ১৯৬৫ সালে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে কিছুদিন বিরত ছিলো। তবে সব সময়ই চেষ্টা করা হয়েছে এর সর্বোচ্চ সুবিধা কীভাবে পাওয়া যায়। গতানুগতিকভাবে চিন্তা করলে হবে না। কারণ, আধুনিক প্রযুক্তির যুগে অবৈধ পণ্য আসা-যাওয়া হচ্ছে কিনা যাচাই করা খুবই সহজ।
এ ব্যাপারে ট্রানজিট তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ট্রানজিট চুক্তির আগে কোনো দেশকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেয়া সংবিধান বিরোধী কাজ। কোনো নির্বাচিত সরকার গোপনে অন্য কোনো দেশকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিতে পারে না।

তিনি বলেন, সরকার ট্রানজিট নিয়ে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। দেশের স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থকেই বড় করে দেখছে। বাংলাদেশের লাভ ক্ষতি নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। বন্দর ব্যবহার করার প্রাপ্য অর্থটুকু বাংলাদেশকে দিচ্ছে না ভারত। তাহলে কীভাবে তাদের বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ অনেক লাভবান হবে। তাহলে কীভাবে লাভবান হবে সেটা প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন?