গাংনীর বামন্দী সততা ক্লিনিকে ভুল অপারেশনে শিশুর মৃত্যুর ঘটনা

4ঘটনাস্থল থেকে ফিরে মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুর গাংনী উপজেলার বামন্দী সততা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারে বিশেষজ্ঞ সার্জন সেজে অপারেশনের পর শিশু মৃত্যুর ঘটনায় আইনি ঝামেলা এড়াতে বাদীর সাথে মীমাংসা করেছে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। গত শুক্রবার রাতে গাংনী থানায় মামলা দায়েরের পর থেকেই বিভিন্ন কৌশলে বাদী পক্ষের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে গতকাল শনিবার দুপুরে সমঝোতায় পৌঁছায় তারা। থানায় দেয়া হত্যা মামলাটি পরে অবশ্য প্রত্যাহার করেন বাদী আবু জাফর। ফলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন হয় শিশুর নুরের মরদেহ। তবে শিশু হত্যার বিষয়টি মীমাংসা হলেও সততা ক্লিনিকের আইনি বৈধতা ও বিতর্কিত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা শেষ হয়নি। স্বাস্থ্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ তাদের সব বিষয় খতিয়ে দেখে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। নিহত শিশু নুরের পিতা এ উপজেলার বাদিয়াপাড়া গ্রামের আবু জাফর গতকাল থানায় অভিযোগ প্রত্যাহার করেন। এর আগে সততা ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ বামন্দীসহ এলাকার অনেকের কাছে ধরনা দেয় মীমাংসার জন্য। গতকাল সকালে স্থানীয় মানুষ, ক্লিনিক পক্ষের কয়েকজন ও বামন্দী থেকে আসা আরও কিছু মানুষ জাফরের বাড়িতে মীমাংসায় বসেন। প্রথমে রাজি না হলেও বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের অনুরোধে মীমাংসায় সম্মত হন আবু জাফরসহ তার পরিবারের লোকজন। মামলা প্রত্যাহার এবং ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সাথে আর কোনো ঝামেলা নেই এ মর্মে সমঝোতা করেন আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে। তবে তা নগদে নয় এক মাসের মধ্যে এ অর্থ হাতে পাবেন আবু জাফর। এমনটিই জানিয়েছেন তার পরিবারের লোকজন। আবু জাফর শুধু মামলা প্রত্যাহারই করেননি। আরও একটি অভিযোগ প্রত্যাহার করেছেন। শিশুর মৃত্যুর সময় টকি মিয়া নামের যে ফার্মেসি মালিক তার স্ত্রীকে ধমক দিয়েছিলেন সে অভিযোগ প্রত্যাহার করে আবু জাফর বলেছেন, টকি মিয়া নয় অন্য একজন। ঘটনার সময় তিনি ভুল করে টকি মিয়ার নামে অভিযোগ করেছিলেন।

গাংনী থানাসূত্রে জানা গেছে, আবু জাফরের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গতকাল সকালে বামন্দী পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ এসআই সামসুল আলম জাফরের বাড়িতে গিয়ে মরদেহ ময়নাতদন্তে প্রেরনের কাজ শুরু করেন। কিন্তু বিষয়টি মীমাংসার পর বাদীর লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি এজাহারভুক্ত না করার পাশাপাশি ময়নাতদন্তও করা হয়নি।

এদিকে সততা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রম শুরু বেশিদিন না হলেও এর বিরুদ্ধে অভিযোগের সংখ্যা কম নয়। এলাকার অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ও আধুনিক চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে বলে প্রায় প্রতিদিনই মাইকিং করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ক্লিনিকে গিয়ে তেমন কোনো সেবা কিংবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পাওয়া যায়নি। মাইকিঙে আকৃষ্ট হয়ে ক্লিনিকে গিয়ে দেখা গেছে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট (ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী পদ) নাজমুল হুদার মতো ক্লিনিকের অনেকেই অপারেশন থেকে শুরু করে সব কাজ করে থাকেন। গ্রামের সহজসরল মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারিত হলেও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের দাপটে কেউই অভিযোগ করতে সাহস করেনি।

গতকাল শনিবার সকালে ক্লিনিকে গিয়ে দেখা গেছে, সামনের কলাপসেবল গেটে তালা ঝুলছে। একটি ডিজিটাল সাইনবোর্ডে ক্লিনিকের নামের পাশাপাশি সেবার তালিকা রয়েছে। ভবনের গায়ে লেখা রয়েছে কয়েকজন চিকিৎসকের নাম। যারা বিভিন্ন সময় চিকিৎসা দিয়ে থাকেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব চিকিৎসকরা সেখানে রোগী দেখেন কি-না সে প্রশ্নের জবাব মেলেনি। স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এমন কোনো চিকিৎসক তাদের নজরে পড়েনি। ক্লিনিকে সাইনবোর্ডে আরও লেখা রয়েছে এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, ইকো, ইসিজি ও কম্পিউটারাইজড প্যাথলজি। তবে কাজির এ গরু কেতাবে দেখা গেলেও গোয়ালে কতোটা সত্য তা খতিয়ে দেখার দাবি করেছেন এলাকার অনেকেই। এলাকার মানুষের অভিযোগ ক্লিনিক মালিক নাজমুল হুদা ও তার ভাই আকরাম হোসেন এবং আরও কয়েকজন সব কাজ করে থাকেন। তারা কখনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সাজেন আবার কখনও দক্ষ ল্যাব বিশেষজ্ঞ সেজেই সেবার নামে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। যার প্রমাণ মিলেছে অপারেশনে শিশু নুরের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে গতকাল মোবাইলফোনে যোগাযোগ করে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, বাদিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক আবু জাফরের সাড়ে চার বছর বয়সী মেয়ে নুর খাতুনের বগোলের ফোঁড়া অপারেশনের জন্য শুক্রবার বিকেলে সততা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করা হয়। বিশেষজ্ঞ সার্জন দিয়ে অপারেশনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে দাবি করা বামন্দীর মোফাজ্জেল হোসেনের ছেলে নাজমুল হুদা অপারেশন করেন। ভুল অপারেশনে রক্তক্ষরণজনিত কারণে অপারেশনের কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যায় শিশু নুর। শিশুকে হত্যার অভিযোগ তুলে স্বজনরা প্রতিবাদ করলে কৌশলে ক্লিনিক তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায় নাজমুল হুদাসহ সংশ্লিষ্টরা। পরে নামজুল হুদাকে প্রধান আসামি করে চারজনের নামে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন আবু জাফর।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *