আল জাজিরাকে প্রধানমন্ত্রী : খালেদার সাথে বিরোধ আদর্শিক

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সাথে তার কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ নেই, তাদের বিরোধ আদর্শিক। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা একসাথে উপস্থিত হন, কথাও বলেন। দুজন নারী দেশের রাজনীতির নীতিনির্ধারক বলেই একটি শ্রেণি তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত। কাতারভিত্তিক আল জাজিরা টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। শেখ হাসিনার এক ঘণ্টার ওই সাক্ষাৎকার গত শুক্রবার রাতে প্রচার করা হয়। প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের নেয়া এ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচনসহ বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা বলেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। জনগণ চাইলে তিনি থাকবেন, না চাইলে নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে অস্বচ্ছতার কথা উড়িয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ চলছে।

সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বাবা বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের প্রসঙ্গ তুলে আবেগাপ্লুত হয়ে যান। এ সময় সাংবাদিক ফ্রস্টকেও বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকতে দেখা যায়। শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের জন্য উৎসর্গীকৃত আমার বাবার জীবন আমি জানি। আমিও প্রস্তুত রয়েছি তাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে। কারণ আমার বাবার অসমাপ্ত কাজ আমাকে শেষ করতেই হবে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধু শীর্ষক ডকুমেন্টারির অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা ও দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নেন প্রখ্যাত এ সাংবাদিক। গত ১০ জুন থেকে ১২ জুনের মধ্যে বাংলাদেশে ধারণ করা সাক্ষাৎকারটিতে উঠে আসে দেশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা, দেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, নির্বাচন ও রাজনীতির নানা কথা।
তথ্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর কিছু দুর্লভ ফুটেজ স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে বিমান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর পা রাখার একটি ফুটেজও আছে। ফ্রস্টই প্রথম বিদেশি সাংবাদিক, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর প্রথম সাক্ষাৎকার নেন।
তথ্যচিত্রের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ডেভিড ফ্রস্ট হাইকমিশনার ও তথ্যমন্ত্রীর সাথে কয়েকবার বৈঠক করেছিলেন। দীর্ঘ ৪৭ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের এ তথ্যচিত্রের শুরুতেই বলা হয়, শেখ হাসিনা, প্রাইম মিনিস্টার অব বাংলাদেশ। ওয়ান অব দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল উইমেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথেও জড়িয়ে গিয়েছিলেন ডেভিড ফ্রস্টের নাম। স্বাধীনতাযুদ্ধের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নেন তিনি। ওই সাক্ষাৎকারেই এদেশবাসীর ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন বঙ্গবন্ধু। সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়ার বিষয়টি।

সাক্ষাৎকার নিতে কখনো বঙ্গবন্ধুর অফিসে, কখনো তার বিখ্যাত সেই ছোট্ট নীল সরকারি গাড়িতে, কখনো ৩২ নাম্বার বাড়ির শোবার ঘরে, বারান্দায় বা লনে গেছেন ফ্রস্ট। বঙ্গবন্ধুও ব্যস্ততার মধ্যে ডেভিড ফ্রস্টের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারটি বিবিসিতে প্রচারিত হওয়ার পরপরই সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ নতুনভাবে সৃষ্টি হয়। এবার বাংলাদেশের মাটিতে এসে প্রথমেই ব্রিটিশ প্রবীণ সাংবাদিক ছুটে যান বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বার বাড়িতে। এই বাড়িতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাতে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুদের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। সেখানে এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে, বীভৎস হত্যাযজ্ঞের আলামতগুলো এখনো স্পষ্ট। ডেভিড ফ্রস্ট ঘুরে ঘুরে সেই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের আলামত প্রত্যক্ষ করেন এবং তার সাথে থাকা আল জাজিরার প্রতিনিধিরা ডকুমেন্টারির জন্য প্রয়োজনীয় ফুটেজও সংগ্রহ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে হেলিকপ্টারযোগে টুঙ্গিপাড়ায় যান ডেভিড ফ্রস্ট। যেখানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত রয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে গিয়েই প্রধানমন্ত্রীর পর বঙ্গবন্ধুর মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি।

এরপর বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবস্থানকালে ব্রিটিশ এ সাংবাদিক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। শুক্রবার দিনগত রাত ২টার দিকে আল জাজিরাতে প্রচারিত হয় এক ঘণ্টার এই সাক্ষাৎকার। ডেভিড ফ্রস্ট
যুক্তরাজ্যের কেন্টে ১৯৩৯ সালের ৭ এপ্রিল জন্ম নেন ডেভিড ফ্রস্ট। দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে সাংবাদিকতা, টেলিভিশন উপস্থাপনা, রম্য লেখনীসহ বিভিন্নধর্মী কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন তিনি।
দীর্ঘদিন বিবিসিতে কাজ করার পর ২০০৬ সালে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার জন্মলগ্নে এর সাথে যুক্ত হন ডেভিড ফ্রস্ট। তিনিই একমাত্র টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, যিনি ১৯৬৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনরত আটজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। পাশাপাশি ১৯৬৯ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে দায়িত্বে থাকা সাতজন মার্কিন প্রেসিডেন্টেরও সাক্ষাৎকার নেয়ার অনন্য কীর্তি স্থাপন করেন তিনি। গত ৩১ আগস্ট চৌকস এ সাংবাদিকের মৃত্যু হয়।