আলমডাঙ্গার আনন্দধামে ১৬ জন আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সন্ধান

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: খোদ আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার আনন্দধাম দক্ষিণপাড়ার ৬-৭ পরিবারের ১৬ জন আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা আর্সেনিকে আক্রান্ত। বর্তমানে তাদের অনেকেই গুরুতর অসুস্থ।

জানা গেছে, আলমডাঙ্গা পৌর শহরের আনন্দধাম দক্ষিণপাড়া বলে পরিচিত একটি পাড়ায় ৫০-৬০ হতদরিদ্র পরিবারের বসবাস। এদের বেশিরভাগই ছিন্নমূল পরিবার। ৮-১০ বছর পূর্ব থেকে এখানে বসবাস। প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই টিউবওয়েল রয়েছে। কিন্তু কোনো টিউবওয়েলের গায়ে লাল কিংবা সবুজ রঙের সঙ্কেত নেই। সম্প্রতি ব্র্যাকের পরিচালনায় আলমডাঙ্গা পৌর এলাকায় ওয়াস কর্মসূচি চলছে। ওই কর্মসূচি পালনের জন্য একটি টিম গত ২০ আগস্ট আনন্দধাম দক্ষিণ পাড়ায় যায়। সে সময় তারা মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে কামালের (৪০) হাতে পুরনো ঘার ক্ষত দেখে জিজ্ঞেস করেন কী হয়েছে? উত্তরে কামাল কিছু বলতে পারেননি। তিনি শুধু জানান যে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করেও কোনো লাভ হয়নি। অবস্থা এমন ভয়াবহ যে এই হাত নিয়ে তিনি স্বাভাবিক কর্মকান্ডও ভালো মতো করতে পারছেন না। ওয়াস টিম সে সময় তাদেরকে জানিয়েছিলো যে এটা আর্সেনিক রোগ। বিষয়টি ওই টিম তাদের প্রগ্রাম অর্গানাইজার হাফিজুর রহমানকে জানান। হাফিজুর রহমান আর্সেনিক আক্রান্তের বিষয়টি সাংবাদিককে জানিয়ে একসাথে গতকাল ওই এলাকা পরিদর্শন করেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। সেখানকার ৬-৭ পরিবারের ১৬ জন আক্রান্ত আর্সেনিক রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের বেশিরভাগ নারী। হাত-পা-মুখসহ শরিরের বেশিরভাগ এলাকায় ফোড়া বের হয়েছে। যা এখন রীতিমতো ঘা। কালো কালো দাগ হয়ে আছে। এরা হলেন– সুজন আলীর স্ত্রী লিপি খাতুন, লিপি খাতুনের মা ফাতেমা খাতুন, লিপির বাপ গোলাম রহমান, আরিফের স্ত্রী ময়না খাতুন, শহিদুল ইসলামের স্ত্রী ফেরদৌসি খাতুন, মৃত দবির উদ্দীনের ছেলে শহিদুল, মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে কামাল হোসেন, কামালের স্ত্রী রাজেদা খাতুন, কামালের ৩ ছেলে সজিব, নাজমুল ও আছি, সজিবের স্ত্রী চুমকি, শরিফুল ইসলামের স্ত্রী চম্পা খাতুন, মৃত মকছেদ আলীর ছেলে মজিবর রহমান (৫০), মজিবর রহমানের স্ত্রী আলেয়া খাতুন ও স্বামী পরিত্যাক্ত কল্পনা খাতুন। একটা ছোট্টপাড়ায় ১৬ জন আর্সেনিক রোগী থাকা ভয়াবহ ঘটনা। এদের বেশির ভাগ প্রায় ২-৩ বছর পূর্বেই আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন তাদের অবস্থা মারাত্মক। তারা যে মারাত্মক আর্সেনিকে আক্রান্ত সেটাও অধিকাংশ আক্রান্তরা জানেন না। তারা স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিয়েছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সবচে’ ভয়াবহ অবস্থা কামালের পরিবারের। তার নাবালক দুটি বাচ্চার অবস্থাও শোচনীয়।

আর্সেনিক আক্রান্তরা জানান,  তাদের শরির ও হাত-পা চুলকায়। জ্বালাপোড়া করে। সারা গায়ে ফুসকুড়ির মতন। আর্সেনিক বিষ দুর্বিসহ করে তুলেছে জীবন। এ পর্যন্ত কোনো সরকারি বা বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান তাদের চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেনি বলেও জানান তারা। গতকাল আর্সেনিক আক্রান্ত একটি পরিবারের টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষার জন্য উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে নিয়ে গেলে তারা তা পরীক্ষা করে দেখেন তাতে আর্সেনিকের পরিমাণ ৬০০ মাইক্রোগ্রাম। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ি প্রতি লিটার পানিতে ১০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে তা দূষিত ধরা হয়। আর বাংলাদেশের মান অনুযায়ি প্রতি লিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে তা আর নিরাপদ পানি বলা যাবে না। তাহলে এখানে বাংলাদেশের মানের চেয়েও ১২ গুন বেশি আর্সেনিক বিদ্যমান। যা ভয়াবহ।

দেশের আড়াইহাজার এলাকায় করা এ গবেষণায় দেখা গেছে, আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের কারণে সাধারণ রোগে গড়ে মৃত্যুঝুঁকি ২১ ভাগ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুঝুঁকি ২৪ ভাগ বেড়েছে।

খুলনা ৫শ বেড হাসপাতালের সাবেক ডাইরেক্টর আলমডডাঙ্গার প্রবীন চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা জানান, আর্সেনিক একটি মারণব্যাধি। আর্সেনিকের সাথে সাথে আরও নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হতে থাকে এ ধরনের রোগীরা। সঠিক সময়ে সুচিকিৎসা না হলে এ রোগে মৃত্যু অনিবার্য। প্রতি লিটার পানিতে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক পান করার ফলে ক্রনিক ডিজিজ, যথা ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়বেটিসের মতো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুঝুঁকি ৬৪ ভাগ বেড়েছে। সাধারণ রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ে প্রায় সমপরিমাণে। গবেষকদের মত, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান না করলে এই মৃত্যু কম হতো।

আলমডাঙ্গা উপজেলা জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত প্রকৌশলী নজিবর হক জানান, আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে এখন কোনো প্রকল্প হাতে নেই। ২০০৩ সালে আর্সেনিকের প্রকল্প ছিলো। সেই প্রকল্পটি এখন চালু নেই তাই ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নলকুপগুলোর আর্সেনিক সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে না। আলমডাঙ্গা-চুয়াডাঙ্গায় আর্সেনিক বিষয়ে নতুন করে গবেষণা ও জরিপের প্রয়োজন। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে জানালেন তিনি।